‘আপনারা একটি ইতিহাস দেখতে যাচ্ছেন’
ভারতবর্ষ তখনও স্বাধীনতা লাভ করেনি। ১৭২১ সালের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ডরা কাঠের দণ্ড ও গোলকের মতো কিছু একটা দিয়ে খেলে অবসরটাকে উপভোগ্য করে তুলতেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার নতুন এই খেলা নিয়ে স্থানীয়দের কৌত‚হলের শেষ নেই। পরবর্তীতে সেই কৌত‚হল থেকেই ভারতবর্ষে শুরু হয় ক্রিকেটের প্রচলন। তবে ক্রিকেটের জন্মটা তারও বহু আগে। পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে ১৫৫০ সালের দিকে খেলাটির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময়টাতে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের কেন্ট, সাসেক্স ও সারি কাউন্টিগুলোতে ক্রিকেট খেলা হতো। পরবর্তীতে নানা পথ-পরিক্রমায় ১৭৪৪ সালে বেশ কিছু নিয়মকানুন যুক্ত করা হয় খেলাটিতে। সেই নিয়মে ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচে মেলবোর্নে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। সেই থেকে যাত্রা শুরু আধুনিক ক্রিকেটের।
পরবর্তীতে এই খেলাটিতে আরও বেশি দর্শক টানতে বেশ কিছু সংক্ষিপ্ত সংস্করণ নিয়ে এসেছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। তবে ক্রিকেটকে সংক্ষিপ্ত করার প্রথম ধাপ ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রচলনটা অবশ্য শুরু হয়েছিল কোনো কিছু না ভেবেই। ১৯৭০-৭১ সালে অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় ইংল্যান্ড। সফরের প্রথম দুটি ম্যাচ শেষ হয় নিষ্প্রাণ ড্রয়ে। তৃতীয় ম্যাচে শুরু হয় বৃষ্টি। টানা তিন দিন বৃষ্টি হলে বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হয় মেলবোর্ন কর্তৃপক্ষ। আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া ও দর্শকদের কথা বিবেচনা করে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের প্রস্তাবে বাড়তি একটি টেস্ট ও পঞ্চম দিনে ৪০ ওভারের একটি ম্যাচ খেলতে সম্মত হয় দুই বোর্ড। যেখানে ওভার ধরা হবে ৮ বলে। অনেকটা মজার ছলেই ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচটিতে খেলতে সম্মত হন দুই দেশের ক্রিকেটাররা। সবাইকে অবাক করে ম্যাচটি দেখতে মাঠে হাজির হন মেলবোর্নের ৪৫ হাজারের বেশি দর্শক। ক্রিকেটের নতুন পথের শুরু ওখানেই। ব্র্যাডম্যান সেদিন মেলবোর্নে উপস্থিত দর্শকদের বর্তমান ওয়ানডে ক্রিকেটের ভবিষ্যদ্বাণীই শুনিয়ে ছিলেন, ‘আপনারা একটি ইতিহাস দেখতে যাচ্ছেন।’
ইতিহাসের প্রথম একদিনের সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডের করা ১৯০ রানের টার্গেট ৪২ বল ও ৫ উইকেট হাতে রেখেই টপকে যায় অস্ট্রেলিয়া। যদিও ওয়ানডে ইতিহাসের শুরুর সেই ম্যাচটি নিয়ে অবশ্য খুব একটা আগ্রহ ছিল না ইংলিশ অধিনায়ক ইলিংওয়ার্থের। বৃষ্টির পর ম্যাচ মাঠে গড়ানোতেই বেশি উচ্ছ¡সিত ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে সেই ম্যাচের স্মৃতি টেনে ইলিংওয়ার্থ বলেন, ‘ড্রেসিংরুমে টানা সময় কাটানোর পর সেদিন মাঠে নামতে পেরেই আমরা খুশি ছিলাম। বাণিজ্যিকভাবে ওয়ানডে ক্রিকেট যে সফল হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ ছিলনা। তবে এখনকার মতো আমরা খুব গুরুত্বসহকারে খেলিনি সেদিন।’
ওই ম্যাচের পর ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। তবে বোর্ডগুলোর ভাবনায় পরিবর্তন আসতে সময় লেগেছে যথেষ্ট। ১৯৭১ সালের পর একদিনের ম্যাচ দেখতে সমর্থকদের অপেক্ষা করতে হয়েছে তিন বছর। ১৯৭৪ সালে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড সফর করে ভারত। ৫৫ ওভারের একদিনের ম্যাচের সিরিজটি ২-০-তে জিতে নেয় ইংল্যান্ড। ম্যাচ দুটিতে ব্যাপক দর্শক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। দ্রুত ম্যাচের ফল আসায় একদিনের ম্যাচের বৈশ্বিক আসর আয়োজন করার কথা গুরুত্বসহকারে ভাবতে শুরু করে আইসিসি। যার ফলশ্রæতিতে ৮ দলের অংশগ্রহণে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন ইংল্যান্ডের মাটিতে বসে প্রথম বিশ্বকাপের আসর। ৬০ ওভারের ওই আসরে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর কেবলই ওয়ানডের জয়জয়কার।
সাফল্য পাওয়ায় প্রতি চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্তনেয় আইসিসি। ১৯৭৯ সালের সে বিশ্বকাপেও শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরের বিশ্বকাপ ১৯৮৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চমকে দিয়ে প্রথম বিশ্বকাপের স্বাদ নেয় কপিল দেবের ভারত। এই সাফল্যের পর এশিয়া অঞ্চলে ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করে ক্রিকেট। প্রসারিত হতে থাকে ক্রিকেটের বাণিজ্য। সেই বাণিজ্য আরও স¤প্রসারিত করতে ম্যাচের পরিধি কমিয়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তনেয় আইসিসি। ইংল্যান্ডের বাইওে প্রথমবারের মতো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় ৫০ ওভারের ক্রিকেট। এতে দর্শক আগ্রহ বেড়ে যায় বহুগুণে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ বিশ্বকাপও আয়োজন করা হয় ৫০ ওভারের ফরম্যাটে, যা এখনও চলমান রেখেছে আইসিসি।