সপ্তম স্বর্গে পৌঁছানোর সাত ধাপ

সপ্তম স্বর্গে পৌঁছানোর সাত ধাপ

গঞ্জালো মন্তিয়েলের পা থেকে বলটা জালের দিকে যখন ছুট দেয়, তখন যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল সব। এই শটের ঠিক আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেসি বলেছিলেন, ‘দাদি, আজকেই সেই দিন।’ স্বর্গ থেকে নিশ্চিত দিয়েগো ম্যারাডোনাও তখন অপলক তাকিয়ে ছিলেন লুসাইল স্টেডিয়ামে দিকে।

তাদের অপেক্ষা দীর্ঘ হয়নি। মন্তিয়েলের শট যেদিক দিয়ে জালে প্রবেশ করেছে, তার উল্টো দিকে ঝাপিয়েছেন ফরাসি গোলকিপার হুগো লরিস। বল জাল ছুঁতেই শুরু উৎসব, দোহা থেকে বুয়েনস আইরেস হয়ে ঢাকা পর্যন্ত। ৩৬ বছরের খরার পর যেন এক পশলা আনন্দবৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে নেচেগেয়ে উৎসব করার পর বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আনন্দে ছেদ পড়েনি এতটুকু। সে জয়যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত এখনো আর্জেন্টাইন সমর্থক থেকে শুরু করে ফুটবলভক্তদের স্মৃতিতে ভাস্বর।

আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের বর্ষপূর্তিতে সে মুহূর্তগুলো আরেকবার মনে করা যাক…

আর্জেন্টিনা ১-২ সৌদি আরব
গ্রুপ পর্ব
২২ নভেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়াম

গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ। ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত আর্জেন্টিনা। সামনে সৌদি আরব। এশীয় ফুটবলের পরাশক্তি হলেও ফুটবলের বিশ্ব মানচিত্রে তাদের অবস্থান ততটা পোক্ত নয়। একটা সহজ জয় দিয়েই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শুরু হবে, এমনটাই হয়ত ধরে নিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা সমর্থকরা। ম্যাচের শুরুটাও হয়েছিল সে বিশ্বাসের সঙ্গে। ১০ মিনিটেই পেনাল্টি থেকে গোল পেয়ে যান লিওনেল মেসি। একের পর এক আক্রমণে তখন দিশাহারা সৌদি আরবের রক্ষণ।

তবে আক্রমণে সে ধার পুরো প্রথমার্ধ জুড়ে কায়েম থাকলেও ব্যবধান আর বাড়েনি। ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে বদলে যায় দৃশ্যপট। বিরতিতে ড্রেসিং রুমে জ্বালাময়ী ভাষণে সৌদি ফুটবলারদের তাতিয়ে দেন কোচ হারভি রেনার। তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই মিনিট তিনেকের মাথায় সমতাসূচক গোল পেয়ে যায় সৌদি আরব। সালেহ আল শেহরির সে গোল যেন দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আর্জেন্টিনা সমর্থকরা।

এর মিনিট পাঁচেক পর সালেম আল দাউসারি দুর্দান্ত ভঙ্গিমায় আরেকটা গোল করে বসেন। আর্জেন্টিনা ১, সৌদি আরব ২। ম্যাচের শেষ বাঁশি পর্যন্ত এই স্কোরলাইন আর পরিবর্তন করা হয়নি আর্জেন্টিনার। দুঃস্বপ্নের এক হারে শুরু হয় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ। যে হারকে ‘বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ফুটবল বিশ্লেষকরা।

আর্জেন্টিনা ২-০ মেক্সিকো
গ্রুপ পর্ব
২৬ নভেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়াম

সৌদির কাছে সেই হারের পর এই ম্যাচ আর্জেন্টিনার জন্য বাঁচামরার পরীক্ষায় পরিণত হয়। হারলেই বিদায়ের সম্ভাবনা প্রকট। একদিকে হঠাৎ ছন্দপতনের দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে বিশ্বকাপে টিকে থাকার লড়াই। মেসি বলেছিলেন, তরুণ এই দলটার উপর বিশ্বাস রাখতে। সমর্থকরা রেখেছিলেন বিশ্বাস, তার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। সেই লুসাইলে-ই আনহেল দি মারিয়ার পাস ধরে মেসির বক্সের বাইরে থেকে করা জাদুকরি এক গোল। মেক্সিকোর বর্ষীয়ান গোলকিপার গিয়ের্মো ওচোয়া পুরোটা শরীর প্রশস্ত করেও সে বলের নাগাল পাননি।

ওই এক গোলেও বদলে যায় বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গতিপথ। সৌদির কাছে হারের পর যে দল শেষ দেখছিল, তাদের ‘নিউরনে অনুরণন’ জাগানোর কাজ করেছিল মেসির ওই গোল। বদলি হিসেবে ফার্নান্দেজ মেক্সিকোর জালে আরেকবার বল পাঠালে ২-০ গোলের সহজ নিয়েই মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টিনা।

পোল্যান্ড ০-২ আর্জেন্টিনা
গ্রুপ পর্ব
৩০ নভেম্বর, স্টেডিয়াম ৯৭৪

সম্ভবত এটাই পুরো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে সহজ ম্যাচ ছিল। পোল্যান্ড-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথের পোস্টারে উত্তাপ ছিল। একদিকে লিওনেল মেসির মুখ, অন্যদিকে রবার্ট লেভানদভস্কির। তবে সে উত্তাপ মাঠে টের পাওয়া যায়নি। দুই দলের শক্তির পার্থক্যটা একটু যেন বেশিই পরিলক্ষিত হয়েছে। শক্তিমত্তায় এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনাও তাই সহজ কাজটা সহজেই ছেড়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার গোলমুখ উন্মুক্ত করার পর আরেকটা গোল যোগ করেন হুলিয়ান আলভারেজ। তাতেই কর্মসাধন।

আর্জেন্টিনা ২-১ অস্ট্রেলিয়া
শেষ ষোলো
৩ ডিসেম্বর, আহমাদ বিন আলী স্টেডিয়াম

যথারীতি মেসি জাদুতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ম্যাচে এগিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। ফের বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের মাপা ফিনিশিংয়ে দলকে শেষ আটের পথে এক ধাপ এগিয়ে দেন লা আলবিসেলেস্তে অধিনায়ক। ৫৭ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন হুলিয়ান আলভারেজ।

কিন্তু দুই গোলে পিছিয়ে পড়ার পরও হতোদ্যম হয়নি অস্ট্রেলিয়া। দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে আকাশি-সাদাদের উপর। যার সুবাদে ৭৭ মিনিটে একটি গোলও পরিশোধ করে তারা। এনজো ফার্নান্দেজের আত্মঘাতী গোলে ভয় ধরে আর্জেন্টিনা দলে। ম্যাচের শেষ দিকে অজি তরুণ গ্যারাং কুয়োল নিশ্চিত গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ওয়ান-অন-ওয়ান পরিস্থিতিতে আর্জেন্টিনা গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেসকে পরাস্ত করতে পারেননি। ফল? ২-১ গোলের জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা।

নেদারল্যান্ডস ২ (৩)- (৪) ২ আর্জেন্টিনা
কোয়ার্টার ফাইনাল
৯ ডিসেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়াম

২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দেখা হয়েছিল আর্জেন্টিনা আর নেদারল্যান্ডসের। সেবার টাইব্রেকারে ডাচদের হৃদয় ভেঙে ফাইনালে গিয়েছিল মেসির আর্জেন্টিনা। সে ম্যাচের একটা ঘটনাবহুল অ্যাকশন রিপ্লেই যেন মঞ্চস্থ হলো লুসাইলে। প্রথমার্ধে মেসির চোখে লেগে থাকার মতো একটা পাস ধরে নাহুয়েল মলিনার গোল আর দ্বিতীয়ার্ধে স্পট কিকে থেকে ব্যবধান বাড়ান। জয় তখন আর্জেন্টিনার হাতের নাগালে।

পেনাল্টি থেকে গোলের পর ডাচ কোচ লুই ফন হালের সঙ্গে একপ্রস্থ বচসা হয় মেসির। ফন হালের সামনে গিয়ে মেসির গোল উদযাপন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশ। তবে এরপরই ছন্দপতন ঘটে আর্জেন্টিনার। ৮৩ ও যোগ করা সময়ের ১১ মিনিটে দুই গোল করে বসেন বদলি ডাচ ফরোয়ার্ড ওয়াউট ওয়েগহর্সট। দুই দলের মাঝে উত্তেজনাও তখন তুঙ্গে।

টাইব্রেকারের মধ্যেও দুই দলের খেলোয়াড়রা বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হন। তবে সব নাটক আর রোমাঞ্চের শেষ দৃশ্যে মঞ্চায়ন হয় আর্জেন্টিনার জয়োৎসব। ৩-৪ ব্যবধানে টাইব্রেকারে হেরে যায় নেদারল্যান্ডস।

আর্জেন্টিনা ৩-০ ক্রোয়েশিয়া
সেমিফাইনাল
১৩ ডিসেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়াম

২০১৮ বিশ্বকাপে কোন হারটা আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল, এই প্রশ্ন উঠলে বোধহয় বেশিরভাগ আলবিসেলেস্তে সমর্থকই গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলের হারকে সামনে আনবেন। রাশিয়ার নিঝনি নভগরদ স্টেডিয়ামে সেদিন গোলকিপারের ভুল আর ছন্নছাড়া খেলায় ক্রোয়াটদের কাছে হেরেছিল আর্জেন্টিনা।

চার বছর পর দোহায় সে হারের মাশুল কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করেছে লিওনেল মেসির দল। সেই ৩-০ ব্যবধানেই জয় নিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা। মেসি পেনাল্টি থেকে একটি এবং আলভারেজ দুটি গোল করেছেন। তবে আলভারেজের দ্বিতীয় গোলটি যেভাবে বানিয়ে দিয়েছেন, তাতে সেটাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বকাপের সেরা অ্যাসিস্টের তকমা দেয়া যায়। ক্রোয়েশিয়ার তরুণ সম্ভাবনাময় সেন্টার ব্যাক ইয়োসকো ভারদিওলকে নাকানিচুবানি খাইয়ে আলভারেজের সে গোলের অ্যাসিস্ট করেন মেসি।

ম্যাচে আলভারেজের প্রথম ও আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলেও মেসির অবদান ছিল। মাঝমাঠে মেসির পা থেকেই বল নিয়ে ছোঁ দৌড়ে গোল করেন আলভারেজ।

আর্জেন্টিনা ৩ (৪) - (২) ৩ ফ্রান্স
ফাইনাল
১৮ ডিসেম্বর, লুসাইল স্টেডিয়াম

বিশ্বকাপ ফাইনাল! আট বছর আগেও মেসি আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ফাইনালে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু সেবার জার্মানদের কাছে হারতে হয় তাদের। তবে এবার আর ছেড়ে কথা বলেনি আর্জেন্টিনা। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ শেষে জয়ের হাসি হাসে আর্জেন্টিনা।

পেনাল্টি থেকে মেসির গোলে শুরু হয় ফাইনালে আর্জেন্টিনার উৎসব। দারুণ একটা টিম মুভ থেকে বল জালে জড়িয়ে দি মারিয়া সে উৎসবে রং ছড়িয়ে দেন। দ্বিতীয়ার্ধে ৮০ মিনিটে পেনাল্টি ও ৮১ মিনিটে দুর্দান্ত এক গোলে ফ্রান্সকে সমতায় আনেন কিলিয়ান এমবাপে। আর্জেন্টিনার উৎসব কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে তাতে। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে মেসি আবার আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিলে শুরু হয় আর্জেন্টিনা সমর্থকদের চূড়ান্ত উৎসবের অপেক্ষা। কিন্তু এমবাপের আরও এক পেনাল্টিতে আবার সমতা ফেরে ম্যাচে। এরপর অতিরিক্ত সময়ে দুই দলই পেয়েছে জয়সূচক গোল করার সুযোগ। এর মধ্যে সেরা সুযোগটা ফ্রান্সের পাতেই পড়েছিল। ১২০+৩ মিনিটে ফাঁকাতে বল পেয়ে যান ফরাসি ফরোয়ার্ড রানদাল কোলো মুয়ানি। কিন্তু গোল ছেড়ে বেরিয়ে এসে দারুণ দক্ষতায় কোলো মুয়ানির শট ঠেকিয়ে দেন আর্জেন্টিনার এমিলিয়ানো মার্তিনেস।

ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে আর্জেন্টিনার সামনে সুবিধা করতে পারেনি ফ্রান্স। গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেসের আগ্রাসী উপস্থিতি নস্যাৎ করে দেয় ফ্রান্সের সব পরিকল্পনা। ৪-২ ব্যবধানে টাইব্রেকার জিতে ৩৬ বছরের ক্ষুধা মেটায় আর্জেন্টিনা। অমরত্বের সুধা পান করে মেসি এবং স্কালোনি কোং।

সম্পর্কিত খবর