আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের নায়কেরা এখন
২০১৮ বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের পর আর্জেন্টিনা দলটাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব পান লিওনেল স্কালোনি। আত্মবিশ্বাসের তলানিতে থাকা একটা দলকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এই তরুণ ম্যানেজার। লিওনেল মেসির নেতৃত্বে ২৬ জনের একটা দুর্দান্ত দল তৈরি করেন। আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের বিশ্বকাপখরা কাটিয়ে সে দল আবার হাসি ফুটিয়েছে কোটি আর্জেন্টাইন ফুটবল ভক্তের মুখে। বিশ্বজয়ের সে কারিগরদের কে কোথায় আছেন, তা নিয়ে সমর্থকদের মনে কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক। তাদের বর্তমান সময়টা কেমন কাটছে তা জানাতেই স্পোর্টস বাংলার এই বিশেষ প্রতিবেদন ।
প্রথমেই সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং আর্জেন্টাইন জাদুকর লিওনেল মেসির কথা জানা যাক। বিশ্বকাপের সময় ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ে ছিলেন মেসি। ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা বার্সেলোনায় কাটিয়ে ২০২১ সালে পিএসজিতে পাড়ি জমান তিনি। প্যারিসের জার্সিতে তার সময়টা অম্লমধুর কাটলেও আর্জেন্টিনার হয়ে উজ্জ্বল ছিলেন মেসি। শুধু ‘উজ্জ্বল’ শব্দটা দিয়ে এই সময়ে আর্জেন্টিনার হয়ে যে অভাবনীয় সুন্দর সময় কাটিয়েছেন তার প্রতি ঠিক সুবিচার করা হয় না।
বার্সেলোনার হয়ে সম্ভাব্য সবকিছু জিতেছিলেন, কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে তার অর্জনের খাতা ছিল ফাঁকা। তাই মেসিকে বেশ কয়েকবার বলতেও শোনা গিয়েছিল, বার্সার হয়ে জেতা সব শিরোপার বিনিময়ে হলেও আর্জেন্টিনার হয়ে একটা শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে চান তিনি। সে শিরোপার দেখা ২০২১ সালে পিএসজির জার্সি গায়ে চড়ানোর পরই জিতেছেন মেসি। ২০২১ সালে ব্রাজিলের মাটিতে ফাইনালে তাদের হারিয়ে কোপা জেতে আর্জেন্টিনা। এরপর ২০২২ সালে ফিনালিসিমা এবং পরম আরাধ্য বিশ্বকাপও জেতেন মেসি।
বিশ্বকাপ জেতার পর সে মৌসুম শেষ হতেই অবশ্য প্যারিস ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান মেসি। সেখানে ইংলিশ কিংবদন্তি ডেভিড বেকহ্যামের মালিকানাধীন ইন্টার মিয়ামির জার্সিতে এখন মাঠ মাতাচ্ছেন মেসি।
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ ৭ গোল করেছিলেন মেসি, তার পরই ৪ গোল করে দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তরুণ ফরোয়ার্ড হুলিয়ান আলভারেজ। বিশ্বকাপের ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেয়া এই ফুটবলার এখনো মাঠ কাপাচ্ছেন সিটিজেনদের জার্সিতে। বিশ্বকাপের পর সিটির মূল একাদশেও তার ভূমিকা বেড়েছে। বিশ্বকাপ জিতেই অবশ্য থেমে যাননি এই তরুণ, সেই মৌসুমেই ইংলিশ চ্যাম্পিয়নদের জিতিয়েছেন ট্রেবল।
বিশ্বকাপ ফাইনালের অন্তিম মুহূর্ত, অতিরিক্তি সময়ের দ্বিতীয়ার্ধও শেষ, চলছে যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিট। আর্জেন্টাইন রক্ষণ দেয়াল টপকে একাই গোলের দিকে ছুটছিলেন ফরাসি ফরোয়ার্ড রানদাল কোলো মুয়ানি। হাত-পা ছড়িয়ে অতিমানবীয় এক সেভে তার নিচু শট ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বজয়ের পথে অটল রেখেছিলেন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ক্যারিয়ারের লম্বা একটা সময় ধারে খেলে আর আর্সেনালের বেঞ্চ গরম করে কেটেছে তার। সেখান থেকে ২০২০ সালে অ্যাস্টন ভিলায় নাম লেখান তিনি। আর্জেন্টিনা কোচ স্কালোনির নজরে আসতে বেশি সময় লাগেনি। প্রায় বিস্মৃত হতে বসা জাতীয় দলে অভিষেকের দুই বছরের মধ্যেই হয়ে যান সর্বজয়ী।
মেসির ছায়া হয়ে থাকেন রদ্রিগো দে পল। ফটোগ্রাফাররা যখনই খেলায় বা অনুশীলনে মেসিকে ক্যামেরাবন্দী করেন, ছবিতে চলে আসেন দে পলও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাই অনেকেই মজা করে তাকে মেসির ‘বডিগার্ড’ নাম দিয়েছেন। তবে দে পল শুধু মেসির পাশেই ছায়া হয়ে থাকেননি, বিশ্বকাপে ত্রাতা হয়েছিলেন আর্জেন্টিনারও। দারুণ পরিশ্রমী দে পল দলের মধ্যমাঠে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, গোল করিয়েছেন, গোল ঠেকিয়েছেন - দলের মনোবল চাঙা করতে মাঠে তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিশ্বকাপের আগের বছর স্প্যানিশ ক্লাব আতলেতিকো মাদ্রিদে নাম লিখিয়েছিলেন, এখনো সেখানেই আছেন এই ‘মিডফিল্ড জেনারেল’।
আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগের দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। তবে বিশ্বকাপের আগে কোপা দিয়েই সবার চোখ খুলে দিয়েছিলেন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আর নিকোলাস ওতামেন্দির সেন্টারব্যাক জুটি। বিশ্বকাপে রক্ষণে পরম আস্থার প্রতীক হয়ে ছিলেন দুজনই। প্রতিভা আর নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন দিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগকে বশ মানিয়েছেন তারা। বিশ্বকাপের আগ থেকেই রোমেরো ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যামে এবং ওতামেন্দি পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকাতে ছিলেন। বিশ্বকাপের পরও পুরনো ক্লাবের জার্সিতে আলো ছড়াচ্ছেন তারা।
রক্ষণের কথা আসলে দুই নাহুয়েল মলিনা আর গঞ্জালো মন্তিয়েলের কথাও বলতেই। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে শেষ আটের ম্যাচে মেসির দুর্দান্ত পাস ধরে মলিনার ঠাণ্ডা মাথার ফিনিশেই ম্যাচে প্রথম এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। আর মন্তিয়েল তো কিংবদন্তির অংশ হয়ে গেছেন। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে টাইব্রেকারে জয়সূচক কিকটি যে তার পা থেকেই এসেছিল। বিশ্বকাপের আগে দুজনই খেলছিলেন স্প্যানিশ ক্লাবে মলিনা আতলেতিকো মাদ্রিদে আর সেভিয়াতে ছিলেন মন্তিয়েল। তবে চলতি মৌসুমে ধারে ইংলিশ ক্লাব নটিংহ্যাম ফরেস্টে নাম লিখিয়েছেন মন্তিয়েল।
বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনার মধ্যমাঠের কম্বিনেশন প্রায় নিশ্চিত ছিল। দে পলের সঙ্গে জিওভানি লো সেলসো আর লিয়ান্দ্রো পারেদেস। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে লো সেলসোর চোট নিয়ে দল থেকে ছিটকে পড়া আর পারেদেস প্রথম ম্যাচে পারফর্ম করতে না পারায় মধ্যমাঠ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে পারতেন স্কালোনি। কিন্তু অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার আর এনজো ফার্নান্দেজ সেটা হতে দেননি। দলে সুযোগ পেয়েই মধ্যমাঠে দে পলের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন তারাও। মেক্সিকোর বিপক্ষে বদলি হিসেবে এনজো আর পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাক অ্যালিস্টার গোলের দেখাও পেয়েছিলেন। এছাড়া ফাইনালে দি মারিয়ার দেয়া গোলটাও বানিয়ে দিয়েছিলেন ‘ম্যাক’। বিশ্বকাপের পর দুজনেরই ক্লাব বদলেছে। প্রায় ১০৭ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসি দলে ভিড়িয়েছে এনজোকে। চেলসির মধ্যমাঠের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। অন্যদিকে ম্যাক অ্যালিস্টারকে ব্রাইটন থেকে রওয়ানা হয়েছেন লিভারপুলের উদ্দেশে।
লেখার শুরুটা হয়েছিল মেসিকে, শেষটা আনহেল দি মারিয়াকে দিয়ে করা যাক। কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়সূচক গোলটি এসেছিল তার পা থেকে। ফিনালিসিমাতেও গোল পেয়েছিলেন। বিশ্বকাপে ফাইনালেও দুর্দান্ত একটা দলীয় আক্রমণ থেকে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন এই ফরোয়ার্ড। বড় ম্যাচে যখনই আর্জেন্টিনার গোল প্রয়োজন হয়, তখনই নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এই অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড। বিশ্বকাপের মাস ছয়েক আগে ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসে নাম লিখিয়েছিলেন।
তবে বিশ্বকাপ জয়ের পর নিজের ক্যারিয়ার সায়াহ্নে ফিরে গেছেন যে ক্লাব দিয়ে শুরু হয়েছিল তার ইউরোপ-যাত্রা, সেই বেনফিকাতে। পেশাদার ক্যারিয়ারে রিয়াল মাদ্রিদ, পিএসজি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন তিনি। আগামী বছর কোপা আমেরিকা দিয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চলেছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের অন্যতম এই নায়ক।
বিশ্বজয়ী এই ফুটবলারদের অনেকেই হয়ত আগামী বিশ্বকাপেও থাকবেন, তবে ওতামেন্দি-আরমানিদের সে বিশ্বকাপে দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর লিওনেল মেসি? ৩৬ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি এখনো অনিশ্চিত। বিশ্বকাপ জেতার পর আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলা উপভোগ করছেন, তবে বছর তিনেক পরে উত্তর আমেরিকার বিশ্বকাপে তাকে দেখা যাবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না খোদ মেসিও।