সেই সাকিবকেই তো চাইবে বাংলাদেশ
খ্রিস্টপূর্ব : যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগের সময়।
খ্রিস্টাব্দ : যিশু খ্রিস্টের জন্মের পরের সময়।
ক্রিশ্চিয়ান ক্যালেন্ডারে সময়ের হিসাব এভাবেই করা হয়। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস এবং পর্যালোচনা পর্বকে আপনি অনায়াসেই ‘সাকিবপূর্ব’ এবং ‘সাকিবীয়’ এই দুই ভাগে ভাগ করতে পারেন। সাকিব খেললে তো বটেই, এমনকি বছরখানেক নিষিদ্ধ থাকাকালেও যে হরদমই তখনও ক্রিকেট শিরোনামের শীর্ষে!
দেশের ক্রিকেটে ব্যক্তিগত অর্জন, সাফল্য, স্বীকৃতি, মর্যাদা– তুল্যমূল্যের হিসাবের রেখচিত্র আঁকতে; কিংবা বিতর্ক-নিষেধাজ্ঞা-শাস্তি কাটিয়ে প্রত্যাবর্তনের তৈলচিত্র বা জলরং ছবির বড় অংশ জুড়েই থাকবে একটা নাম– সাকিব আল হাসান!
আনন্দের শীর্ষে সাকিব। বিতর্কেও তাই! আর শেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ব্যাটে-বলে সাকিব যা করেছিলেন সেটা এক অর্থে ঈর্ষণীয় সাফল্য। সেই পরিসংখ্যানটা আগে দেই। ৮ ম্যাচে ৬০৬ রান। সেঞ্চুরি দুটি। হাফ সেঞ্চুরি ৫টি। রান গড় ৮৬.৫৭। উইকেট শিকার ১১। যে তিনটি ম্যাচ সেই বিশ্বকাপে জিতেছিল বাংলাদেশ, সেই তিন ম্যাচেই সাকিব ম্যাচসেরা।
এই পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের বিচারে সেই বিশ্বকাপটা দুর্দান্ত কেটেছিল সাকিবের। বাংলাদেশ যদিও বেশিদূর যেতে পারেনি সেবার। কিন্তু অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সাকিব রাঙিয়ে দিয়েছিলেন ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপকে।
মাঠে তো বটেই, মাঠের বাইরের বড় অংশ জুড়েও তার ক্রিকেটীয় প্রভাব এমনই যে, সাকিবকে হিসাবের বাইরে রেখে আপনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের কোনো অংশই সাজাতে পারবেন না। বেড়ে ওঠা, নিজেকে নিজের মতো গড়ে তোলার ক্রিকেটীয় এই পথে সাকিব কখনো-সখনো সমস্যা-সংকট নিজেই তৈরি করেছেন। হেঁয়ালির খেয়ালে ভেসেছেন। নিজের ইচ্ছে, আনন্দকে সঙ্গী করে সামনে বেড়েছেন। নিজেকে তৈরির তার এই আনন্দময় পথচলার নিজস্ব সিলেবাস, চিরায়ত এবং প্রথাগত অনেক রুটিন ভেঙেচুরে একাকার করেছে বলেই হয়তোবা রক্ষণশীলতার পাহারাদাররা সালিশি বসিয়েছে; দরজায় তুলেছে খিল! কিন্তু নিজের খেলা প্রথম বলেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা হাঁকানোর দাপুটে সাহস যে রাখে তার স্বপ্ন-সীমানাকে মামুলি চৌকাঠে আটকে রাখার সাধ্য কি আছে কারও?
২০১৯ সালের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত সময় কাটানো সাকিব আল হাসান পরের বছরের অক্টোবরে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সংকটে পড়লেন। আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় এক বছর সব ধরনের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন। সাকিব ভুল করেছিলেন। ক্রিকেট জুয়াড়ি তাকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, সেই তথ্য সাকিব যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিধিবিধান অনুযায়ী এটি বড় ভুল। আইসিসি সেই ভুলের বিচার করেছে এবং শাস্তি দিয়েছিল। নিষিদ্ধ হওয়ার পর কঠিন সেই সময়ে লড়াইটাও সাকিব একাই লড়লেন। একটু দেরিতে হলেও ঠিকই জিতলেন।
সৃষ্ট সমস্যা এবং শাস্তির কারণ সাকিব নিজেই। তাই সমাধানের পথও নিজেই খুঁজে বের করার চেষ্টায় নামলেন। নিষেধাজ্ঞার ৩৬৫ দিনের প্রতিদিনকে সেশন বাই সেশন খেলে জেতার লড়াইয়ে নামলেন। এই পুরোটা সময় লড়লেন ‘ওয়ানম্যান আর্মির’ সেই পুরোনো সূত্র মেনে। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর সেই লড়াইয়েও জিতলেন। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে সাকিবের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়।
২০১৯’র ২৯ অক্টোবর যেদিন সাকিব নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা শুনলেন; সেদিন কষ্টের কান্নায়, বিষণ্ণতায় মুষড়ে পড়া এক সাকিবকে দেখেছিলাম বিসিবির বারান্দায়। সামনে একগাদা ক্যামেরা, ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বলতা। কিন্তু সেই রাতে সাকিবের দু’চোখে কী ভীষণ শূন্যতা! আর ঠিক বছর খানেক বাদে ২০২০’র ২৯ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে নতুন ইনিংস শুরুর দিনে সাকিব মোটেও কোনো উল্লাস করেননি। সেঞ্চুরির পর আলতো অবহেলায় ব্যাট উঁচিয়ে তোলার মতো করে এদিন শুধু নতুন করে শপথ নিলেন– ‘নতুন ইনিংসটা বড় করতে হবে। নিরাপদ ক্রিকেট খেলতে হবে!’
পরিণতি তৈরি করে পরিমিতিবোধ। সেই সুচিন্তাই আজ সাকিবকে আবার অধিনায়কত্বের রাজ আসন দিয়েছে। চার বছর আগের বিশ্বকাপের সাকিবকে ঘিরেই এবারও স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ। দলে আরও ১৪ জন ক্রিকেটার আছেন। কিন্তু সেরা সারথি যে ওই একজনই– সাকিব আল হাসান।
সবাই যখন দুশ্চিন্তায় কাঁধ ঝুঁকিয়ে ফেলে, সাকিব তখন ঠিকই উঠে দাঁড়ান। নতুন করে উঠে দাঁড়িয়ে নতুন করে শপথ নেন– ‘২২ গজই আমার ঠিকানা। কঠিন সময় যাচ্ছে। কিন্তু ফিরব আরও কঠিন হয়ে। চেষ্টা করে চলেছি রাতদিন, অবিরাম। লাল-সবুজের হয়ে মাঠে রঙ ছড়াতে। মনে একটাই স্লোগান– ‘খেলবে টাইগার, জিতবে টাইগার। সঙ্গে আছেন তো?’
–অবশ্যই আছে!
সাকিবের সঙ্গেই তো ছিল পুরো বাংলাদেশ। আছে এবং থাকবেও। গেল বিশ্বকাপে আলো ছড়ানো সেই চমকপ্রদ পারফর্মার সাকিবকে আরও একবার দেখার অপেক্ষায় পুরো বাংলাদেশ।