হোয়াটমোরের সঙ্গে মাশরাফির লুকোচুরি, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার ইনিংস
‘বয়স হয়েছে। ধোঁয়ায় ঢাকা একটা ঘটনা মনে পড়ছে। দিনটা মনে হয় কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। আমরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করছিলাম। কে একজন দেখিয়ে দিল কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে আসা ছেলেটিকে। দীর্ঘদেহী, শক্ত গড়নের লিকলিকে একটা ছেলে। কাছে আসতেই শিশুর মতো মুখটা নজর কাড়লো। কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিল। আমি ইংরেজি বলছিলাম বলে মনে হয় একটু বেশি সঙ্কুচিত ছিল। একটু সময় নিয়ে ওর জড়তা ভাঙ্গানোর জন্য নামটা আবার জিজ্ঞেস করলাম। মাথা নিচু করে একটু লাজুক হেসে বললো- মাশরাফি বিন মুর্তজা।
হ্যাঁ, আপনাদের জন্য মাশরাফি বিন মুর্তজা; ম্যাশ। আমার কাছে পাগলা!’
মাশরাফির সঙ্গে নিজের পরিচয় পর্বটা এভাবেই তুলে ধরেছিলেন কোচ ডেভ হোয়াটমোর। ক্যারিয়ার, ক্রিকেট, ছেলেবেলা, নড়াইলের জীবন নিয়ে মাশরাফির একটা বই আছে, সেই বইয়ের নামও মাশরাফি। কোচ ডেভ হোয়াটমোর সেই বইয়ের মুখবন্ধে এভাবেই মাশরাফির সঙ্গে নিজের পরিচয়ের সূত্রটা গেঁথেছেন।
কোচ ডেভ হোয়াটমোরের দলে খেলোয়াড় হিসেবে বেশ কয়েকবছর খেলেছেন মাশরাফি। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে মাশরাফি ছিলেন বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম নায়ক। ডেভ হোয়াটমোর তখন বাংলাদেশের কোচ। সেই বিশ্বকাপের পর অবশ্য হোয়াটমোর চাকরি বদলে অন্যত্র চলে যান। তারপরও হোয়াটমোরের সঙ্গে মাশরাফির দেখা সাক্ষাত তেমন হয়নি।
এবার হলো। সোমবার মিরপুর ক্রিকেট একাডেমির মাঠে দুজনের সঙ্গে দেখা হলো। গলাগলি হলো। আড্ডা হলো। ভালোবাসা, শ্রদ্ধার বিনিময় হলো। ডেভ হোয়াটমোর এবারের বিপিএলে ফরচুন বরিশালের প্রধান কোচের দায়িত্বে। আর মাশরাফি বিন মুর্তজা সিলেট স্ট্রাইকার্সের অধিনায়ক। একই মাঠে দু’দলের অনুশীলন ছিল সোমবার (২১ জানুয়ারি)। দূর থেকে প্রিয় কোচকে দেখে মাশরাফির মনে একটু দুষ্টুমি খেলে গেল।
কোচের সঙ্গে একটু লুকোচুরি খেললেন মাশরাফি। মুখের সামনের অংশটুকু টুপি দিয়ে ডেকে সামনে এসে চমকে দিলেন গুরুকে। হোয়াটমোর কিছুটা চমকে উঠলেও সামলে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বুকে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় পাগলাকে। বাকিটা সময় দুজনে গল্পে গল্পে মেতে উঠেন। মাশরাফির খোঁজখবর নিলেন ডেভ।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এই অস্ট্রেলিয়ানকে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন মাশরাফি। দুজনের সম্পর্ক এতটাই ভালো ছিল যে ২০০৬ সালে ডেভ নড়াইলে গিয়েছিলেন মাশরাফির বিয়েতে। বর্ষীয়ান কোচ হোয়াটমোরের কাছে মাশরাফি যেন সেই আগের মতোই দুষ্টু পাগলা। তাদের দুজনের একসঙ্গে চলার সময়টা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুন্দরতম সময়!
কোচ ডেভ হোয়াটমোর এবং তার সেই দলের সেসময়কার অন্যতম সেরা পারফরমার মাশরাফি বিন মুর্তজা। দুজনের ‘জুটি’ জমতে বেশ। মাশরাফি তার স্বভাবসুলভ কায়দায় মাঠ, মাঠের বাইরে এবং ড্রেসিংরুম মাতিয়ে রাখতেন। কোচ হোয়াটমোর জানতেন এই ছেলেটা দুষ্টুমির মধ্যেও সবচেয়ে বেশি যে বিষয় নিয়ে সিরিয়াস তা হলো ক্রিকেট। মানুষ মাশরাফিকে সবচেয়ে ভালোভাবে চিনতে পেরেছিলেন কোচ হোয়াটমোর নিজেই। আদর করে ডাকতেন-পাগলা বলে!
কোচ ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে মাশরাফির সম্পর্কটা স্রেফ খেলার মধ্যেই আটকে ছিল না। মাশরাফির বইয়ে তার সম্পর্কে নিজের ধারণার কথা বলতে গিয়ে কোচ ডেভ হোয়াটমোর লিখেছেন, ‘আমি জীবনে কখনো কোনো খেলোয়াড়ের পক্ষে পক্ষপাত দেখাইনি। পাগলার প্রতিও দেখাইনি। তবে একটু বলতে পারি, মানুষ হিসেবে আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর একজন হয়ে উঠেছে পাগলা; আজও তাই আছে।’
সোমবার একাডেমিতে হোয়াটমোরের সঙ্গে মাশরাফির দুষ্টুমি, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার সেই দৃশ্যপট জানালে এখনো সম্পর্কটা অমনই আছে। সুন্দরতম!