দুর্দান্ত ঢাকা কেন ‘দুর্দশার’ ঢাকা?
বিপিএলের শুরুর দিকে ঢাকা ছিল টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী ফ্র্যাঞ্চাইজি। প্রথম চার আসরের তিন বারের চ্যাম্পিয়নরা সময় যত গড়িয়েছে, রঙ হারিয়েছে ততই। শেষ কয়েক আসর ধরে তো একেবাওে লেজেগোবরে দশা! ২০২২ আর ২০২৩ দুটো ভিন্ন নামে খেলেছে এই সময়, কিন্তু গ্রুপ পর্বের গণ্ডিটা আর পেরোনো হয়নি।
এবার আরও একবার নাম বদলে ঢাকা আসে বিপিএলে। নামটাও বাহারি, ‘দুর্দান্ত ঢাকা’! প্রথম ম্যাচে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে হারিয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছিল দারুণ কিছুর। কিন্তু এরপরও আবারও সেই পুরোনো বঞ্চনার গল্প। নামের দুর্দান্ত ঢাকা কাজে ‘দুর্দান্ত’ হতে পারল না, হয়ে রইল সেই ‘দুর্দশা’র ঢাকাই! এবার অবশ্য অতীতের সব রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেল। টানা আট ম্যাচ হেরে গড়ল ইতিহাস, এক ম্যাচ পরেই শেষ দুর্দশার রেকর্ড এখন টানা ৯ ম্যাচে হার। বিপিএল ইতিহাসে এখন টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হারার বাজে রেকর্ডটা তাদের দখলেই।
কিন্তু কেন এমন হলো দলটার? বিপিএলের লিডার বোর্ডের দিকে একবার চোখ বোলান, শীর্ষ পাঁচ ব্যাটারের তালিকায় আছেন দলটির অন্তত দুই ব্যাটার। বোলারের তালিকাতেও আছেন একজন, শরিফুল ইসলাম। তবু কেন ঢাকা দুর্দান্ত হতে পারল না?
কারণ দলটার সামষ্টিক ব্যর্থতা। নাইম শেখ শুরু ও মাঝের দিকে যখন নিয়মিত রান পাচ্ছিলেন যখন, তাকে সমর্থন দেওয়ার কেউ ছিল না। তার আগে দানুশকা গুনাথিলাকা, লাসিথ ক্রসপুল্লেরা যখন রান পাচ্ছিলেন, তাদেরও কেউ সমর্থন যোগাতে পারেনি। তাদের ইনিংস বড় করার আগে ফিরে যাওয়ার সমস্যাও ছিল বেশ। তবে এখন যখন অ্যালেক্স রস বড় ইনিংস পাচ্ছেন, তখনও তিনি লড়ছেন একাই। এমন দৃশ্যের দেখা প্রতি ম্যাচেই মিলেছে, তাই স্কোরবোর্ডে রান আসছে না! হারের ব্যবধানটা কমছে, কিন্তু দিনশেষে হারটা আর এড়ানো যাচ্ছে না।
একই পরিস্থিতি দলের বোলিংয়েও। শরিফুল ইসলাম প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। কিন্তু তার পাশে আর কেউ নেই। এখানে তিনিও নিঃসঙ্গ যোদ্ধা। তাসকিন আহমেদ শুরুর দিকে পাঁচ ম্যাচে ভালো বোলিং করেছিলেন, তুলে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। এরপর থেকে তিনিও নিস্প্রভ। সব মিলিয়ে বোলিংয়েও ‘এক্স ফ্যাক্টর’ নেই।
সব কিছুর চেয়ে বড় সমস্যা দলটার দেখা দিয়েছিল অধিনায়কত্বে। মোসাদ্দেক হোসেন ব্যাট আর বল হাতে এখন পর্যন্ত ডাহা ফ্লপ, ৭ ম্যাচে দুটো ডাকসহ রান ৩৬, বল হাতে ৬ ইনিংসে বল করে উইকেট পেয়েছেন মোটে দুটো। এরপর তার অধিনায়কত্ব নিয়েও ছিল প্রশ্ন। ছন্দে থাকা তাসকিন-শরিফুলকে ব্যবহার করতে পারেননি। পরিস্থিতিটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ম্যাচে তার একমাত্র মূল্যবান অবদান স্রেফ টস করা। যে কারণে তাকে ‘চোটের’ কারণ দেখিয়ে বাদ দেয় ঢাকা। এরপর সবশেষ ম্যাচে তিনি ফিরেছেন বটে, কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে নয়, সাধারণ খেলোয়াড় হিসেবে। ফিরে আরও এক দফায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি, সবশেষ ম্যাচের প্রথম ওভারেই করেছেন বিশাল এক ওয়াইড, যা জনমনে রহস্যের জন্ম দিয়েছে রীতিমতো।
দলের বিদেশী রিক্রুট নিয়েও আছে প্রশ্ন। মানসম্মত বিদেশী যে দলটা আনতে পারেনি, তার প্রমাণ মেলে অ্যালেক্স রস বাদে আর কারো দলে থিতু হতে না পারায়। শন উইলিয়ামসকে আনা হয়েছে সবশেষ, যিনি বর্তমানে আছেন ক্যারিয়ার সায়াহ্নে, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর ডাকও পান না এখন আর, শুধু ঢাকাই ডাকল তাকে।
আরও একটা কারণও অবশ্য আছে, পরিকল্পনার অভাব। শুরুতে আইএল টি-টোয়েন্টি আর এসএ টি-টোয়েন্টির ছায়ায় পড়ে গেছে বিপিএল, শেষের দিকে পিএসএলের। ফলে বিদেশী খেলোয়াড় আনতে বাড়তি পরিকল্পনা চাই, সেটা যে পারেনি ঢাকা, তা খেলোয়াড়দের আসা যাওয়ার মিছিলেই স্পষ্ট।
সঙ্গে যোগ করুন কমিশন বানিজ্যকেও। দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানাচ্ছে, সব বিদেশীকে দলে আনা নিয়ে হয়েছে কমিশন বানিজ্য, যা গেছে দলটিরই এক কর্তার পকেটে। মানসম্মত বিদেশী না পাওয়া, আর খেলোয়াড়দের এমন আসা যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকাই রেখেছে এই বিষয়টি।
খানিকটা দুর্ভাগ্যও ঢাকার সঙ্গী হয়ে আছে বৈকি! নাহয় দেখুন সিলেট স্ট্রাইকার্সের এবারের পরিস্থিতিটাও ছিল ঢাকার মতোই। কিন্তু মাঝ মৌসুমে অধিনায়ক বদলে নিজেদের ভাগ্যটাও বদলে দিয়েছে দলটা। মাঝ মৌসুমে অধিনায়ক বদলেছে ঢাকাও কিন্তু তাদের ভাগ্য আর বদলায়নি। উল্টো অধিনায়কত্বের ভারে তাসকিন আহমেদই আরও নুয়ে পড়লেন রীতিমতো। এটা দুর্ভাগ্য নয়তো কী? এ সবকিছুর মিশেলেই এমন দুর্দশায় পড়েছে ঢাকা। এবারের মৌসুমে এ থেকে বেরোতে পারার সম্ভাবনাটাকেও এখন ক্ষীণই মনে হচ্ছে। পরের দুই ম্যাচ জিতলেও তাদের সামনের বাড়ার কোন উপায় নেই। এবারের বিপিএল থেকে সবার আগে বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে তাদের।
পরের মৌসুমের জন্য আগাম চিন্তা ও পরিকল্পনা এখন শুরু করতেই পারে ঢাকা!
ঢাকার দুর্দশার নমুনা-
প্রতিপক্ষ | হারের ব্যবধান |
চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স | ৬ উইকেট |
রংপুর রাইডার্স | ৭৯ রান |
খুলনা টাইগার্স | ১০ উইকেট |
সিলেট স্ট্রাইকার্স | ১৫ রান |
রংপুর রাইডার্স | ৬০ রান |
সিলেট স্ট্রাইকার্স | ৫ উইকেট |
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স | ৪ উইকেট |
ফরচুন বরিশাল | ৪০ রান |
ফরচুন বরিশাল | ২৭ রান |