রংপুর-বরিশাল ছাপিয়ে কোয়ালিফায়ার যেন সাকিব-তামিম ‘ক্লাসিকো’
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার কাল। তাতে মুখোমুখি রংপুর রাইডার্স আর ফরচুন বরিশাল। চলমান বিপিএলে দুই ম্যাচে, আর ম্যাচের পর যে ঝাঁজটা দেখা গেছে দুই দলের মধ্যে, তাতে কালকের তৃতীয় লড়াইটা আর যাই হোক আর দশটা ম্যাচের মতো যে নয়, তা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।
তবে এই দ্বৈরথের ঝাঁজও ছাপিয়ে যাচ্ছে আরেকটা লড়াই। সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালের ‘লড়াই’। এক সময়ের দুই বন্ধু ভেতরের সম্পর্কটা আগের মতো নেই, কথাটা বহু আগেই জানা গিয়েছিল বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন মারফত। তবে সেটা যে সাপে-নেউলে পরিস্থিতিতে গিয়ে পৌঁছেছে, সেটার আঁচ মিলেছিল গেল ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগ মূহূর্তে। এরপর বিপিএলে দুজনের দুই দলের লড়াই এলেই কথা উঠেছে দুই জনের এই ব্যক্তিগত লড়াই নিয়েও।
মঞ্চটা যখন দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারের, তখন লড়াইয়ের মাহাত্ম্যটা বেড়ে যায়। রংপুর বরিশাল বলুন বা সাকিব-তামিমের দ্বৈরথ… এক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। অতীতের কথা একপাশে রাখলেও সাকিব-তামিমের দ্বৈরথের বিষয়টা বহাল থাকে তার জায়গায়। কেন? দুজনই যে নিজ নিজ দলের প্রাণভোমরা!
এবারের বিপিএলে তামিম আছেন দারুণ ছন্দে। দলের জয়ে নাম ভূমিকায় থাকছেন নিয়মিত। এই সবশেষ দুই ম্যাচেও তিনি ফিফটি করেছেন। দলের জয়ে বড় ভূমিকাই রেখেছেন। টানা দুটো ফিফটি করেছেন। সবশেষ ম্যাচে তো পুরো খেলা শেষ করে তবেই উঠেছেন, অন্যটাতে তিনি যখন বিদায় নিচ্ছেন, তখন দলের প্রয়োজন ছিল মোটে ১৯ রান, তাও ১৩ বল থেকে।
এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত ৩৭ ছুঁইছুঁই গড়ে তিনি করেছেন ৪৪৩ রান, স্ট্রাইক রেটটাও মন্দ নয়, ১২৫.৫০। বর্তমানে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় দুইয়ে তার অবস্থান। বিপিএলের শুরুটা অবশ্য ভালো ছিল না তার। রান করছিলেন, কিন্তু বড় কিছুতে রূপ দিতে পারছিলেন না। দলও ধুঁকছিল তাই।
তবে বিজনেস এন্ডে এসে তিনি জ্বলে উঠলেন। যখন তার জ্বলে ওঠাটা খুব বেশি দরকার ছিল, বরিশালের তখনই স্বরূপে ফিরলেন। দলও জয়ের ধারায় ফিরল। শেষ দল হিসেবে নিশ্চিত করল প্লে অফ।
তামিম তাও কিছু রান করছিলেন শুরু দিকে, তবে সাকিবের পরিস্থিতিটা ছিল আরও খারাপ। শুরুর পাঁচ ম্যাচে ৪ ইনিংসে তিনি করেছিলেন মোটে ৫ রান। বল হাতে অবশ্য তিনি ছিলেন ছন্দেই। তবে সময় যত গড়িয়েছে, তামিমের মতো সাকিবও ব্যাট হাতে নিজেকে ফিরে পেয়েছেন। ব্যাটিং অর্ডারে ওপরের দিকে এসে দ্রুত কিছু রান তুলে দিয়ে দলকে দিয়েছেন মহাগুরুত্বপূর্ণ ‘বুস্ট’। তাতে চড়েই প্রায় প্রতি ম্যাচে রংপুর পেয়েছে লড়াকু পুঁজি।
বল হাতে অবশ্য তিনি শুরু থেকেই ছন্দে ছিলেন। আছেন এখনও। ১২ ম্যাচ খেলে তিনি তুলে নিয়েছেন ১৭ উইকেট। গড়টাও ঈর্ষণীয়, ১৬.২৯, স্ট্রাইক রেটও প্রায় কাছাকাছিই। ইকনমি রেটটাও বেশ স্বাস্থ্যকর, ঘুরোফেরা করছে ৬ এর আশেপাশে। তার সঙ্গে যখন ব্যাট হাতে ১৬২ স্ট্রাইক রেটে তার ২৫৪ রান যোগ করবেন, তখন তাকে টুর্নামেন্ট সেরার দৌড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনেই হতে পারে আপনার।
এমন সব পরিসংখ্যান বলছে, তারকাখচিত রংপুর আর বরিশালের সবচেয়ে বড় তারকার নাম সাকিব আর তামিম। এই দুই তারকার লড়াই অবশ্য স্রেফ এ কারণেই মনোযোগটা টেনে এনেছে, তা নয় মোটেও।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই দুই মহীরুহ হরিহর আত্মা থেকে সাপ-নেউল বনে গেছেন সেই বহুদিন ধরেই। কারণ না জানালেও গেল বছর বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছিলেন বিষয়টা। এরপর বিশ্বকাপের তিন মাস আগে তামিমের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া, এরপর সাকিবের নেতৃত্বে আসার পর বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে আরও। বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণার আগে তামিমের নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, এরপর বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে দুজন দুজনকে ইঙ্গিতপূর্ণ যে কথাগুলো বলেছেন, তারপর থেকে বিষয়টা অনেক পরিষ্কারই হয়ে গিয়েছিল যে, দুজনের সম্পর্কটা আর যাই হোক, বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বন্ধুর।
মাঠে দুইজন মুখোমুখি হলেন যখন, সবকিছুর ছাপ সেখানেও পড়ল। দুই জনের প্রথম লড়াইয়ে অবশ্য তেমন কিছুরই আঁচ মেলেনি। সাকিব দুই অঙ্কে যাওয়ার আগে আউট হয়েছেন। এরপর তামিম ইকবাল ব্যাটিংয়ে সাকিবের মুখোমুখি হয়েছেন, তার বলে আউট না হলেও বেশ সমঝে ব্যাট করেছেন, ৭ বলে নিয়েছেন ৫ রান।
দুই জনের শেষ লড়াইয়ে ঝাঁজটা মিলল। সাকিব আক্রমণে আসার আগ পর্যন্ত তামিম ছিলেন বেশ মারমুখী মেজাজে। ১৯ বলে করে ফেলেছিলেন ৩৩। এরপর সাকিবের প্রথম বলেই বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল তার। সাকিব তার মতো করেই উদযাপন করলেন।
জবাবে রংপুর যখন ব্যাট করতে নামল, সাকিবও শুরুটা করলেন তামিমের মতো আক্রমণাত্মক মেজাজে। ১৫ বলে করলেন ২৯। এরপর যখন মেহেদি হাসান মিরাজের বলে তিনি আউট হলেন, এরপর তামিম প্রতিক্রিয়া দেখালেন সাকিবের উদযাপন ‘কপি’ করে। মুখ বাঁকিয়ে, উদযাপনের কপিটা যখন করলেন, তখন তা আবারও ‘টক অফ দ্য টাউন’ হয়ে গেল। রংপুর আর বরিশালের লড়াইটা যে এই দুজনেরও ব্যক্তিগত দ্বৈরথের, সে বিষয়টাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
দুই দল আরও একবার মুখোমুখি কাল সন্ধ্যায়। সেখানে কে শেষ হাসিটা হাসবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে দুই জনের দ্বৈরথে বড় মঞ্চে সবচেয়ে বড় জয়টা তামিম ইকবালেরই পক্ষে। ২০১৯ বিপিএলের ফাইনালে ১৪১ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলেছিলেন তামিম, সেদিন সাকিব ছিলেন বিজিত দলে। কালকের কোয়ালিফায়ার তারই পুনরাবৃত্তি হবে নাকি তার বিপরীতটা? সে যাই হোক, তার কোনো একটা হলেও ‘সাকিব-তামিম ক্লাসিকো’ নামটা রীতিমতো স্বার্থকতা পেয়ে যায়।