বিপিএল ফাইনালের নয়-কাহন
২০১২ সালে অনেক স্বপ্ন, অনেক সম্ভাবনা নিয়ে পর্দা উঠেছিল বিপিএলের। তখন দেশে-দেশে টি-টোয়েন্টি লিগ ছিল না, প্রতিযোগিতা বলতে ছিল শুধু আইপিএল। তবে সময়ের পরিক্রমায় আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের শিখরে অবস্থান করলেও বিপিএল চলে গেছে পাদপ্রদীপের আড়ালে। পিএসএল, সিপিএল, আইএল টি-২০, এসএ২০, এলপিএলের মতো ভুরিভুরি ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের ভিড়ে এখন যুদ্ধ করেই টিকে আছে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এই প্রতিযোগিতা। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিপিএল পার করেছে এক দশক।
রাত পোহালেই বিপিএলের দশম আসরের ফাইনাল। মুখোমুখি টুর্নামেন্টের সফলতম দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স এবং প্রথম শিরোপার খোঁজে থাকা ফরচুন বরিশাল।
এই ফাইনালের চলুন এক নজর দেখে আসা যাক, কেমন ছিল বিপিএলের আগের ৯ আসরের ফাইনাল। কারা শিরোপা জিতেছিল, কাদের পারফরম্যান্স এখনো স্মরণীয় আছে - সেসব আপনাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতেই এই লেখা।
২০১২ বিপিএল ফাইনাল
বরিশাল বার্নার্স-ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স
মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে টসে জিতে আগের বরিশালকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানায় ঢাকা। দুই পাকিস্তানি বোলার শহীদ আফ্রিদি এবং রানা নাভেদ-উল-হাসানের বোলিং তোপে ২০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ১৪০ রানের বেশি তুলতে পারেনি বরিশাল। আফ্রিদি ২৩ রান তিনটি এবং নাভেদ ২৪ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। বরিশালের পক্ষে ওপেনার ব্র্যাড হজ ৭০ রানের হার না মানা ইনিংসে দলের স্কোর ভদ্রস্থ হলেও চ্যালেঞ্জিং হয়নি।
তারকায় ঠাঁসা ১৪১ রানের লক্ষ্য তাড়া করে ৪.২ ওভার হাতে রেখে। ৪৩ বলে ৭৫ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে ফাইনালসেরা হন ঢাকার পাকিস্তানি ওপেনার ইমরান নাজির। সঙ্গে এনামুল হক বিজয়ের ৩৮ বলে ৪৯ রানের হার না মানা ইনিংসে চড়ে ২ উইকেট হারিয়েই বিপিএলের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে মাশরাফি মুর্তজার ঢাকা।
২০১৩ বিপিএল ফাইনাল
ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স-চিটাগং কিংস
বিপিএলের দ্বিতীয় আসরেও নিজেদের জয়রথ অব্যাহত রাখে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স। টসে হেরে আগে ব্যাট করে এনামুল হক (৫৮) এবং সাকিব আল হাসানের (৪১) ব্যাটে চড়ে ১৭২ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে ঢাকা। কিংসের পেসার রুবেল হোসেন ৪ ওভারে ৪৪ রান খরচায় ৪ উইকেট। তবে ঢাকার রান তাড়া করতে নেমে ৬৫ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে কিংস। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৪৪ এবং ইংলিশ ওপেনার জেসন রয় ৪০ রানের দুটি ইনিংস খেললেও তা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে লাগেনি। আলফনসো থমাস এবং প্রয়াত মোশাররফ রুবেল দুজনই তিনটি করে উইকেট নিয়ে কিংসকে ১২৯ রানে অলআউট করাতে বড় ভূমিকা রাখেন।
৪৩ রানের জয়ে টানা দ্বিতীয় শিরোপা ছুঁয়ে দেখার আনন্দে ভাসে ঢাকা। ফাইনালসেরা হয়েছিলেন ২৬ রানে ৩ উইকেট নেয়া মোশাররফ রুবেল।
২০১৫ বিপিএল ফাইনাল
বরিশাল বুলস-কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স
শুক্রবার (১ মার্চ) বিপিএল ফাইনালের দুই প্রতিপক্ষ বরিশাল এবং কুমিল্লার আগেও ফাইনালে দেখা হয়েছিল। ২০১৫ বিপিএলে বরিশালের আগের ফ্র্যাঞ্চাইজি বুলসের মুখোমুখি হয় ভিক্টোরিয়ান্স। আর এই বরিশালকে হারিয়েই প্রথম শিরোপার স্বাদ পেয়েছিল বিপিএলের সফলতম ফ্র্যাঞ্চাইজি কুমিল্লা।
মিরপুরের শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় কুমিল্লা। ব্যাটিংয়ে নেমে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ (৪৮) এবং শাহরিয়ার নাফিসের (৪৪*) চল্লিশোর্ধ্ব দুটি ইনিংসে ভর করে ১৫৬ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
টানটান উত্তেজনা ছড়ানো ম্যাচে শেষ বলে জয়সূচক রান পায় কুমিল্লা। অলক কাপালি শেষ চার বলে ১১ রান তুলে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। ২৮ বলে ৫ চারে ৩৯ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসের সুবাদে ফাইনালসেরা হন বাংলাদেশের সাবেক এই অলরাউন্ডার।
২০১৬ বিপিএল ফাইনাল
ঢাকা ডায়নামাইটস-রাজশাহী কিংস
বিপিএলের ইতিহাসে অন্যতম একপেশে ফাইনাল খেলেছিল ঢাকা এবং রাজশাহী। টস জিতে আগে ফিল্ডিং করা রাজশাহী ঢাকাকে ১৫৯ রানে আটকে দিতে সক্ষম হয়। রাজশাহীর মিডিয়াম পেসার ফরহাদ রেজা ২৮ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তাতে বড় ভূমিকা রাখেন। ঢাকার পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৫ রান আসে কিউই ওপেনার এভিন লুইসের ব্যাটে।
তবে ১৬০ রান তাড়া করতে নেমে নাভিশ্বাস ছুটে যায় রাজশাহীর। সাকিব আল হাসান, সানজামুল ইসলাম এবং আবু জায়েদ রাহি সমান দুটি করে উইকেট নিয়ে রাজশাহীর প্রথম শিরোপা ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন নস্যাৎ করে দেন। দুর্বল ব্যাটিং প্রদর্শনীতে ১৭.৪ ওভারে ১০৩ রানে অলআউট হয়ে যায় ড্যারেন স্যামির রাজশাহী। ফাইনালসেরা হন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি উইকেটকিপার-ব্যাটার কুমার সাঙ্গাকারা।
২০১৭ বিপিএল ফাইনাল
রংপুর রাইডার্স-ঢাকা ডায়নামাইটস
আবারও টানা দুই শিরোপা জয়ে দ্বারপ্রান্তে ছিল ঢাকা। তবে এবার তাদের সামনে দেয়াল তুলে দাঁড়ান রংপুরের ক্রিস গেইল। টসে হেরে ব্যাট করতে নামা রংপুরকে ২০৬ রানের পাহাড়ে পৌঁছে দেন ‘ইউনিভার্স বস’। ৬৯ বলে ১৮ ছক্কায় খেলেন ১৪৬ রানের হার না মানা এক মহাকাব্যিক ইনিংস। অন্যপ্রান্তে অনেকটা ‘মুগ্ধ দর্শকের ভূমিকা’য় থাকা ব্র্যান্ডন ম্যাককালামও করেন ৪৩ বলে ৫১* রান।
জবাব দিতে নেমে ঢাকার জহুরুল ইসলাম অমি (৫০) বাদে বড় ইনিংস খেলতে পারেননি কেউ। যার ফলে ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১৪৯ রানে থামতে হয় তাদের। ৫৭ রানের বড় জয়ে প্রথমবারের মতো বিপিএল শিরোপা ছুঁয়ে দেখে রংপুর।
২০১৮ বিপিএল ফাইনাল
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স-ঢাকা ডায়নামাইটস
এবার বিপিএলের ফাইনালে গেইল ছিলেন না। তবে গেইলের মতো ধুন্ধুমার ব্যাটিং ছিল ঠিকই। গেইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কুমিল্লার জার্সিতে গায়ে চরানো দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। টসে হেরে আগে ব্যাট করা কুমিল্লার হয়ে ইনিংস ওপেন করতে নেমে ৬১ বলে ১৪১ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেন তামিম, যাতে ছিল ১০ চার এবং ১১ ছক্কার মার। তার একার ব্যাটে চড়েই ঢাকাকে ২০০ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় কুমিল্লা।
রনি তালুকদারের ৬৬ এবং লঙ্কান ওপেনার উপুল থারাঙ্গার ৪৮ রানের ইনিংস দুটির সুবাদে কাছাকাছি পৌঁছে যায় ঢাকা। তবে শেষতক লক্ষ্য থেকে ১৭ রান দূরে থেমে যায় ঢাকা। দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জয়ের উৎসব করে কুমিল্লা।
২০১৯ বিপিএল ফাইনাল
রাজশাহী রয়্যালস-খুলনা টাইগার্স
আন্দ্রে রাসেলের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে খুলনাকে ২১ রান হারিয়ে প্রথমবার বিপিএল শিরোপা জয় করে রাজশাহী। ফাইনালে টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে ইরফান শুক্কুরের (৫২) ফিফটি এবং মোহাম্মদ নওয়াজের ২০ বলে ৪১ রানের ঝোড়ো ইনিংসে ২০ ওভারে ৪ উইকেটে ১৭০ রান করে রাজশাহী।
১৭১ রান তাড়া করতে নেমে রাইলি রুশোর (৫২) ফিফটির পরও ১৪৭ রানের বেশি করতে পারেনি খুলনা। ১৬ বলে ২৭ রানের ক্যামিওর সঙ্গে বোলিংয়ে দুই উইকেট শিকার করে ফাইনালসেরা হন রাজশাহী অধিনায়ক আন্দ্রে রাসেল।
২০২২ বিপিএল ফাইনাল
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স-ফরচুন বরিশাল
তর্কসাপেক্ষে বিপিএল ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ফাইনাল উপহার দিয়েছিল শুক্রবার (১ মার্চ) বিপিএল ফাইনালের দুই প্রতিপক্ষ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স এবং ফরচুন বরিশাল।
পূর্বের সব বিপিএল আসরে টসে জেতা দল আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেও সে ধারায় ছেদ টানে কুমিল্লা। টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন কুমিল্লার অধিনায়ক ইমরুল কায়েস। বরিশালের নিয়ন্ত্রিত বোলিং সামলে ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৫১ রান স্কোরবোর্ডে জমা করে তারা। ওপেনার সুনীল নারাইন (৫২) বাদে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলতে পারেননি কেউ। তবে মিডল অর্ডারে ৩৮ রানের একটি কার্যকরী ইনিংস খেলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার মঈন আলি।
রান তাড়ায় নেমে ১ রানের আক্ষেপে পুড়তে হয় বরিশালকে। শেষ ওভারে ১০ রান প্রয়োজন ছিল দলটির। তবে ক্রিজে থাকা দুই ব্যাটার তাওহিদ হৃদয় এবং মুজিব-উর-রহমান মিলে ৮ রান তুলতে পেরেছিলেন। রোমাঞ্চকর সেই ফাইনাল জিতে তৃতীয় শিরোপা জয়ের উৎসব করে কুমিল্লা। ২৩ বলে ৫৭ রানের দুরন্ত ইনিংস খেলে ফাইনালসেরা হন নারাইন।
২০২৩ বিপিএল ফাইনাল
সিলেট স্ট্রাইকার্স-কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স
ঢাকার পর টানা দুইবার শিরোপা জয়ের কীর্তি গড়ে কুমিল্লা। সবমিলিয়ে বিপিএলের প্রথম দল হিসেবে পায় চার শিরোপার স্বাদ। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে মুশফিকুর রহিমের হার না মানা ৭৪ এবং নাজমুল হোসেন শান্তর ৬৪ রানের ইনিংসে ১৭৫ রানের চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ পায় সিলেট। তবে মুশফিক-শান্তর ইনিংস দুটি জলে যায় লিটন-চার্লসের বীরত্বে। ৫২ বলে ৭৯ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন চার্লস, ৫৫ রান আসে লিটনের ব্যাটে।
তাদের ব্যাটিং নৈপুণ্যে ৪ বল ও ৭ উইকেট হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় তারা।