যাবার আগে এবার রাঙিয়ে দিয়ে যাও হে!
শ্রদ্ধাস্পদেষু
বিরাট কোহলি
বিরাট কোহলি, ২০১১ সালের ওই মন ভালো করা ছবিটা আজও স্মৃতিতে অটুট। যতদিন বাঁচব, ততদিন ওই ছবিটা উজ্জ্বল হয়েই থাকবে।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সতীর্থদের কাঁধে সচিন তেন্ডুলকর। ততক্ষণে বিশ্বজয় করে ফেলেছে ভারত। আলতো করে তিনি ধরে আছেন জাতীয় পতাকা। গ্যালারিতে মন্দ্রিত হচ্ছে ‘বন্দে মাতরম’। চিরদিনের ফ্রেমে সচিন।
আপনি, বিরাট কোহলি কলার তুলে সেই সময়ে বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেটকে বয়ে নিয়ে এসেছেন, তার তো এই কাঁধে তুলে সেলিব্রেশনই প্রাপ্য।’
আপনারা সচিনকে কাঁধে তুলে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ করছিলেন। গোটা ভারত নেমে এসেছিল ওই ওয়াংখেড়েতে।
কবি সুবোধ সরকারের লাইন আশ্রয় করেই ২০১১ সালের ২ এপ্রিলকে বর্ণনা করি মিস্টার বিরাট কোহলি।
কে যেন ওই ভিড়ের মধ্য থেকে বলে উঠল।
‘মা, দেখ, কী সুন্দর দেখাচ্ছে আমাদের ছেলেটাকে’।
কে বলল কথাটা?
আমি
কে আমি? তারাতলায় থাকো।
না, আমি রাজারহাটে থাকি, আমি বারাসতে থাকি।
আমি বহরমপুর, আমি বালুরঘাট, আমি কুচবিহার।
রাত্রি সাড়ে বারোটা। আকাশ থমথমে। ভারতবর্ষের আকাশচিরকালই থমথমে। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে ভারতবর্ষ।
গরিবের ভারত, অভিজাতের ভারত, দলিত ভারত।
জগৎ-সভায় ভারত আবার শ্রেষ্ঠ।
বিরাট কোহলি, এক যুগ বাদে ফের ফিরিয়ে আনুন সেই দৃশ্য। কল্পচোখে দেখছি, আপনি সতীর্থদের কাঁধে চেপে মাঠ ছাড়ছেন। গ্যালারিতে মন্দ্রিত হচ্ছে, জনগণমন অধিনায়ক...। আপনি অধিনায়ক না হয়েও জনগণমনের অধিনায়ক।
এবারের বিশ্বকাপই হয়তো আপনার শেষ বিশ্বকাপ। শেষ বিশ্বকাপ রাঙিয়ে দিয়ে যান আপনি।
আপনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। সচিন তেন্ডুলকর নামের এক মিথকে আপনি ধাওয়া করে চলেছেন অবিরত। তার কক্ষপথের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছেন।
বিশ্বমঞ্চে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটন বয়ে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে। আপনি অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন একাধিক দ্বিপক্ষীয় সিরিজের শিরোপা। খেতাব জেতার পর ধন্য ধন্য করেছি আমরা। কিন্তু বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারেননি একক দক্ষতায়।
২০১১-এর পরবর্তী সময়ে আপনিই ছিলেন আমাদের অগতির গতি, অক‚লের কুল, অনাথের নাথ। কিন্তু প্রতিবারই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে আপনাকে।
বিরাট কোহলি, ভুলব না কোনো দিন ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পর শহর কলকাতায় আপনার বিস্ফোরণ।
সেবারের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের পর সবাই দুয়ো দিয়েছিলেন আপনার স্ত্রী আনুশকা শর্মাকে। আনুশকা মাঠে বসে খেলা দেখেছিলেন। তার জন্য হারতে হয়েছে ভারতকে, এমন গঞ্জনা শুনতে হয়েছিল আপনাকে।
তখনও আনুশকা আপনার প্রেমিকাই। বিয়ে হয়নি আপনাদের। কলকাতায় এক সাংবাদিক বৈঠকে উগড়ে দিয়েছিলেন যাবতীয় অভিমান।
বিরাট কোহলি, আপনি প্রতিবাদী। তাই এক অসহায় নারীর অসম্মান সহ্য করতে পারেননি।
বিরাট কোহলি, আপনি সব অর্থেই ব্যতিক্রমী। ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপের ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। তবে আপনি তখন নেহাত নাদান। ফাইনালে ভারতের বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে গম্ভীরকে সঙ্গ দেওয়া সেই ছোট্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসের কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, আপনি যে তখনও বিরাট কোহলিই হননি। তখন আপনাদের ওপর থেকে প্রচারের সব আলো শুষে নিয়েছিলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর নামের এক খর্বকায় মারাঠী।
বিরাট কোহলি, ক্রিকেটে হয়তো আপনি কিলিয়ান এমবাপে। আবির্ভাবেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তবে লিওনেল মেসি, সচিন তেন্ডুলকর কিন্তু বহু দূরের পথ। দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। প্রতি স্টেশনে সঙ্গী থাকে সর্বগ্রাসী হাহাকার। রক্তাক্ত হতে হয় সমালোচনায়। দিতে হয় ধৈর্যের পরীক্ষা। এতদিনে নিশ্চয় বিরাট কোহলি আপনি বুঝতে পেরে গিয়েছেন তারকা হওয়ার যন্ত্রণা। প্রশংসা যেমন পেয়েছেন, তেমনই প্রবল বেগে আপনার দিকে ধেয়ে এসেছে সমালোচনা। বিরাট কোহলি আপনি মনে হয় উপলব্ধি করেছেন, মাঠে নেমে প্রতিপক্ষের বাউন্সার-বিমার মোকাবিলা করা এর থেকে বোধহয় অনেক সহজসাধ্য কাজ। কারণ তখন তো আপনার হাতে একটা ব্যাট থাকে। যে ব্যাট রাতের ঘুম কেড়ে নেয় প্রতিপক্ষের।
২০১১’র বিশ্বজয়ের পর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ বারো বছর। সময়ের হিসাবে এক যুগ। আপনি নিতান্তই এক আনকোরা প্রতিশ্রæতিমান তারকা থেকে এখন সর্বকালের সেরাদের ব্র্যাকেটে। একের পর এক ব্যক্তিগত রেকর্ড ভেঙেচুরে গিয়েছে আপনার উইলোর আঘাতে। রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্য, এই আপ্তবাক্যকে বহুবার সত্যি প্রমাণ করেছেন আপনি। তবে আপনার নিজের করে নেওয়া বিশ্বকাপ যে এখনও আসেনি।
আপনি ক্যাপ্টেন হয়েছেন। নেতা হিসেবে দুর্লঙ্ঘ সব শৃঙ্গ আরোহণ করেছেন। সাফল্যের এই বাগিচায় আপনি হেঁটে গিয়েছেন মাইলের পর মাইল। আর আপনার ব্যাটিং দেখতে এমনই কত দূরত্ব অতিক্রম করেছেন ক্রিকেটভক্তরা।
তবু কোথাও কি লুকিয়ে থাকে না বিশ্বকাপকে নিজস্ব করে নেওয়ার আকুতি? আপনি বনস্পতি। আপনি ভারতীয় ক্রিকেটকে ছায়া দিয়েছেন, ফুল দিয়েছেন, ফল দিয়েছেন। ক্রিকেটবিশ্ব কুর্নিশ জানায় আপনাকে। আপনার সান্নিধ্য পেতে মুখিয়ে থাকে দুনিয়ার সেরা সব ক্ষণ-অনুক্ষণ, পল-অনুপল।
সাফল্যের এই রঙচঙে রাংতায় হয়তো নিভৃতে লুকিয়ে রয়েছে আপনার বিশ্বকাপ-খিদে। সোনালি কাপকে একান্তে আপন করে নেওয়ার আকাক্সক্ষা।
বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার জন্য সচিন তেন্ডুলকরকে অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছিল ২২ বছর। বিশ্বকাপ ঘরে এলো যখন, সচিন তখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে।
এই ২২ বছরে সচিন রাজ্যপাট বিস্তার করেছেন। শাসন করেছেন ক্রিকেটবিশ্বকে। গঞ্জনা কি সহ্য করতে হয়নি তাকে? সবাই বলেছেন, ‘বিশ্বকাপ জিততে পারোনি তুমি।’ এর জেরে কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন আপনি তার ইয়ত্তা নেই।
বিরাট কোহলি, মহানায়করা ফুরিয়ে যাওয়ার আগে, নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো জ্বলে ওঠেন। সচিন পেরেছিলেন। আর্জেন্টিনার মহানায়ক লিওনেল মেসি বিশ্বজয় করেছেন। এবার কি আপনার সময়?
মিস্টার কোহলি, ২০১১’র সাজঘরের কথা বেরিয়ে আসছে একটু একটু করে। চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য বীরেন্দ্র সহবাগ স্মৃতি রোমন্থন করে বলছিলেন, দলের সবাই সচিনের জন্য বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছিল। সবাই যদি এক লক্ষ্যে, এক মন্ত্রে ঝাঁপায়, তাহলে সাফল্য এসে ধরা দেয়। এ যে পৃথিবীরই নিয়ম।
আমরা সবাই বলছি, এবার আপনার জন্য বিশ্বকাপ জিততে নামুক টিম ইন্ডিয়া। ক্রিকেট দলগত খেলা। দলগত খেলাতেও একক নৈপুণ্য পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। অতীতেও আপনি বহুবার তা দেখিয়েছেন।
এবারের বিশ্বকাপে কোহলি যে আরও একবার বিরাট হয়ে উঠবেন না, তা কে বলতে পারে!
আমরা তো সেরকমই এক বিরাট-পর্ব দেখার অপেক্ষায় রয়েছি। আপনার জন্য হৃদয় এখন থেকেই গাইতে শুরু করেছে, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে।’
ইতি
আপনার অনুরাগী
কৃশানু মজুমদার