১৮ বলে সিরিজ জেতানো ইনিংসের গল্প
হাসারাঙ্গার সেই বলটা গ্যালারির যে কোনো জায়গায় গিয়ে পড়তে পারতো। এতোই বাজে বল ছিল সেটা। ক্রিকেটের ভাষায় যাকে বলে লংহপ। কিন্তু চরম বাজে সেই বলে পুল শট খেলতে গিয়ে একটু বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেললেন মেহেদি মিরাজ। ব্যাটের কানায় লেগে বল আকাশে উঠে। বাউন্ডারি লাইনের সামনে ক্যাচটা নেন প্রমোদ মাধুসান। এমন বলে উইকেট খুইয়ে হতাশ মেহেদি মিরাজ। আর অন্যপ্রান্তে তখন বাহু ফুলিয়ে উল্লাস করছেন হাসারাঙ্গা। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখাবয়বে। বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসলেন হাসারাঙ্গা। তবে ম্যাচে সেটাই তার মুখের শেষ হাসি। বাকি সময় কেবল কষ্টে পুড়লেন! শ্রীলঙ্কার হারে তিনিই যে বড় ভিলেন!
ক্যাচটা হতেই টিভি ক্যামেরা জুম করলো মেহেদি মিরাজের দিকে। অবাক বিস্ময়, হতাশ, নীরবতা তার এমন চাউনির শারীরিক ভাষা থেকেই জানা হয়ে গেল ম্যাচে বড্ড বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। আর এই অবস্থার জন্য দায়ী তিনি। মন খারাপের ভঙ্গি নিয়ে ডাগআউটে ফিরলেন মেহেদি মিরাজ। তবে এই ম্যাচে সেটাই বাংলাদেশের মন খারাপে শেষ দৃশ্য। বাকি সবটুক জুড়ে যে কেবল আনন্দের লহরি!
৪০ বলে ১৮ রান তুলে মেহেদি মিরাজ ডাগআউটে ফিরছেন মনখারাপের ভঙ্গি নিয়ে। স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশ ৩৬.১ ওভারে ৬ উইকেটে ১৭৮ রান। ম্যাচ জিততে তখনো চাই ৮৩ বলে ৫৮ রান। হাতে জমা ৪ উইকেট।
মিরাজ মাঠ ছাড়ছেন। রিশাদ হোসেন প্রবেশ করছেন। কমেন্ট্রিবক্সে ধারাভাষ্যকাররা বলছেন, ম্যাচের দৃশ্যপট বদলে গেল। বাংলাদেশ বিপদে। কিন্তু তাদের ভাবনাটা ছিল ভুল। বড্ড ভুল। রিশাদ হোসেন উইকেটে এসে যে শ্রীলঙ্কার বিপদ বাড়িয়ে দিলেন। ক্রমশ জমে উঠা ম্যাচটা পুরোপুরি একপেশে করে দিলেন। একপ্রান্ত থেকে তার ব্যাটেই শ্রীলঙ্কার বোলিং বিভাগ চূর্ণবিচূর্ণ।
রিশাদ মাঠে নামার ২৫ বলের মধ্যেই এই ম্যাচের গল্প শেষ।
সপ্তম উইকেটে জুটিতে চোখের পলকেই যোগ হলো অপরাজিত ৫৯ রান। যে জুটিতে রিশাদ খেললেন মাত্র ১৮ বল। করলেন ৫ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায় হার না মানা ৪৮। যেখানে মুশফিকের যোগাড় ৭ বলে ১১।
রিশাদের খেলা প্রথম বল থেকে শুরু হলো সেই গল্প। বাংলাদেশের ইনিংসের তখন ৩৭ নম্বর ওভারের খেলা চলছে। উইকেটে এসে মুশফিকের সঙ্গে আলাপ সেরে নিলেন রিশাদ।
কি ছিলো সেই কথা?
মুশফিক: আমাদের এখনো অনেক রান দরকার। পঞ্চাশের বেশি। আমি এদিকটা সামাল দিচ্ছি। নিজের জোনে বল পেলে তুমি মেরে দিও।
‘মেরে দিও’!
মুশফিকের কাছ থেকে এই নিশ্চয়তায়ই রিশাদের ব্যাটে যেন আগুন ধরিয়ে দিল। তার ব্যাটের বিস্ফোরণে শ্রীলঙ্কার বোলিং বিধ্বস্ত, চুরমার! ম্যাচ জেতাতে মাত্র ১৮ বল খেলার সময় নিলেন রিশাদ।
সেই গল্পের বিস্তারিত শুনি।
৩৬.২ ওভার: রিশাদের খেলা প্রথম বল। ওটাই আবার ছক্কা! হাসারাঙ্গার রংঅনকে আগেই রিড করতে পারলেন। একটু ঝুঁকলেন। হাঁটু সামনে বাঁকিয়ে বল যেদিকে টার্ন নিচ্ছিলো সেদিকেই হাঁকালেন। সুইট টাইমিং। মিড উইকেটের ওপর দিয়ে বল মাঠের বাইরে। ছক্কা দিয়ে রিশাদের ইনিংস শুরু।
৩৬.৩ ওভার: হাসারাঙ্গার পরের বলটাও রংঅন। ব্যাট সামনে বাড়িয়ে খেলেন রিশাদ। ব্যাটে বলে হয়নি। বল লাগে প্যাডে। জোরালো আপিল করে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু আম্পায়ার তানভির আহমেদ জানান নটআউট। রিভিউ নেয় শ্রীলঙ্কা। বল লেগস্ট্যাম্পে লাগার ইঙ্গিত থাকলেও আম্পায়ার্স কলে রক্ষা পান রিশাদ। ডট বল।
৩৬.৪ ওভার: মিডঅন দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকান রিশাদ। বল খাানিকটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন হাসারাঙ্গা। দারুণ ইতিবাচক ভঙ্গিতে সেই বল বাউন্ডারিতে পাঠান রিশাদ।
৩৬.৫ ওভার: এবার আরেকটি ছক্কা! ফুলার লেন্থে বল রাখেন হাসারাঙ্গা। বল যেদিকে টার্ন নিচ্ছিল সেদিকেই খানিকটা ঝুঁকে সুইপের ভঙ্গিতে মিড উইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারেন। বল বাউন্ডারি দড়ির বাইরে।
৩৬.৬ ওভার: পেছনের পায়ে গিয়ে অফসাইডে খেলেন রিশাদ। কোনো রান এলো না এই বলে।
এই ওভারে পাঁচ বল খেলেন রিশাদ। দুই ছক্কা ও এক বাউন্ডারিতে রান নেন ১৬!
পরের ৩৮ নম্বর ওভারটি করেন পেসার লাহিরু কুমার। রিশাদ এই ওভারে খেলেন তিন বল। নেন দুটি সিঙ্গেল। আগের ওভারে বেদড়ক মার খাওয়ায় হাসারাঙ্গাকে আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক কুশাল মেন্ডিস। আক্রমণে আনেন আরেক স্পিনার মাহেশ তিকশানাকে। তিকশানার সেই ওভারে ৪ বল খেলেন রিশাদ। একটি বাউন্ডারি ও দুটি সিঙ্গেলে সেই ওভার থেকে রিশাদের সংগ্রহ ৬ রান। সবমিলিয়ে ১২ বলে তার যোগাড় তখন ২৪।
এরপরই এলো রানবন্যার সেই ওভার। হাসারাঙ্গা প্রান্ত বদলে আক্রমণে এলেন।
৩৯.১ ওভার: প্রথম বলেই ছক্কা! নিজের আয়ত্তে পাওয়া বলে স্লগ সুইপ খেলেন রিশাদ। বল মিড উইকেট দিয়ে গ্যালারিতে।
৩৯.২ ওভার: ফের ছক্কা! রিশাদকে শট খেলার আহবান জানান হাসারাঙ্গা। এক হাঁটু গেড়ে জোরে ব্যাট চালান রিশাদ। ব্যাটের সুইট পার্টে লাগে বল। কাউকর্নার দিয়ে বল বাউন্ডারির দড়ির ওপারে।
৩৯.৩ ওভার: একটু অফসাইডে বল রাখেন হাসারাঙ্গা। পা পেছনে নিয়ে কাট খেলেন রিশাদ। অফসাইডের ফিল্ডাররা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলেন শুধু। বল মাটি ঘেঁষে বাউন্ডারিতে।
৩৯.৪ ওভার: এবার বল লংঅনে পাঠালেন রিশাদ। ফিল্ডার দৌড়ে বলের নাগাল পাওয়ার আগেই বাউন্ডারি। ক্লিন হিট!
৩৯.৫ ওভার: আবার বাউন্ডারি! বাম পা সামনে বাড়িয়ে মিড উইকেট দিয়ে শট খেলেন রিশাদ। ফিল্ডার ছিলেন সেখানে। কিন্তু বলের গতির সঙ্গে পেরে উঠলেন না তিনি। চার!
৩৯.৬ ওভার: ফুল লেন্থে পড়া বলে রানের জন্য গেলেন না রিশাদ। নিজের ফলোথ্রুতে বল কুড়ালেন হাসারাঙ্গা। কিন্তু মুখে তার আর কোনো হাসি নেই। থাকবে কিভাবে? ওই ওভারে তার খরচ হয়েছে ২৪ রান। দুই ছক্কা। তিন বাউন্ডারি! ম্যাচ মূলত ওই ওভারেই ফয়সালা।
ওভার শেষে রিশাদের রান ১৮ বলে ৪৮। বাংলাদেশ তখন ম্যাচ জয় থেকে ৩ রান দুরে দাড়িয়ে। বল বাকি ৬০!
তিকশানার পরের ওভারে প্রথম বলে মুশফিক কোনো রান নিলেন না। ইচ্ছে ছিল সিঙ্গেল নিয়ে রিশাদকে স্ট্রাইক দেবেন। যাতে তার হাফসেঞ্চুরি পুরো হয়। সেই লক্ষ্যে তিকশানার পরের বলে অফসাইডে ঠেলে সিঙ্গেল নেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বল তার ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারি। ওতেই বাংলাদেশের জয়ের টার্গেট পুরো।
ডাগআউট থেকে দল ছুটল মাঠে দুই সতীর্থকে জয়ের অভিনন্দন জানাতে। রিশাদ হোসেনকে জড়িয়ে ধরলেন মুশফিক। স্কোরবোর্ডে রিশাদের নামের পাশে তখন ১৮ বলে হার না মানা ৪৮ রানের বিস্ফোরক ইনিংস। ৫ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায় তার সেই ইনিংসেই যে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের গল্পগাথা। শেষের সেই ঝড়েই ম্যাচসেরার ট্রফিও উঠলো তার হাতে।
হাসারাঙ্গা এখন অনেকদিন দুঃস্বপ্নেও দেখবেন রিশাদ হোসেন বিশাল সব ছক্কা হাঁকাচ্ছেন তার বলে!