বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্বপ্নের সারথীরা
এক নির্বাচকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
-দল নির্বাচন তো শেষ। এখন তো আপনাদের রিল্যাক্স করার কথা।
-আরে ভাই, কি যে বলেন? এখনই তো আরো বড় টেনশনের শুরু। দল তো দিলাম। এখন দল মাঠে কেমন পারফরমেন্স করে সেটা দেখতে হবে না?
-তা দেখবেন। কিন্তু মাঠে তো আর আপনি বা নির্বাচকরা গিয়ে খেলে দেবে না। খেলবেন তো মাঠের ১১ ক্রিকেটার। ভালো করার দায়িত্ব তো ওদের।
নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই অধিনায়ক জানালেন, আসলে ক্রিকেটে সবাই ধন্যবাদ পায় না। নির্বাচক ও আম্পায়ারের কাজটা হলো থ্যাংঙ্কলেস জব। দল ভালো করলে সেটা বাকিদের কৃতিত্ব। আর খারাপ করলে সেটা নির্বাচকদের দোষ।
অমুককে কেন নিলো। ওকে কেন বাদ দিলো। ইত্যাদি ইত্যাদি। আম্পায়ারদের ক্ষেত্রেও তাই। ভালো কোনো নিখুঁত সিদ্ধান্ত দিলে কোনো বাহবা নেই। কিন্তু হিউম্যান এরর এর কারণে সামান্য কোনো ভুলচুক হলেই শ্লোগান উঠে- ভুঁয়া আম্পায়ার!
যে কোনো টুর্নামেন্টের জন্য নির্বাচকরা দল নির্বাচক করেন অনেককিছু হিসেব নিকেষ করে। প্রতিপক্ষ, কন্ডিশন, টুর্নামেন্টের আকার, সময়, কে কোন পজিশনের জন্য ফিট, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে কে কেমন আচরণ কওে, খেলোয়াড়ের মানসিক অবস্থা-ইত্যাদি অনেক বিষয় বিবেচনা রেখেই তারা দল নির্বাচন করে থাকেন।
এবারের বিশ্বকাপ দলের জন্যও তেমনই অনুষঙ্গের হিসেব নিকেষ কষে তারা পনের জনের দল চুড়ান্ত করেছেন। এই দলটি চুড়ান্ত। তবে দলের কেউ ইনজুরিতে পড়লে তার বদলি নেওয়ার নিয়মকানুনও রয়েছে।
এই রিপোর্টে আসুন আমরা চিনে নেই আমাদের এবারের বিশ্বকাপের স্বপ্নের সারথীকে। যাদের ঘিরে পুরো বাংলাদেশ অনেক বড় স্বপ্ন দেখছে।
সাকিব আল হাসান : বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা তার বেশ। সেই ২০০৭ সাল থেকেই বিশ্বকাপ খেলছেন। এবার নিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপের আসরে খেলতে নামছেন সাকিব। নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বিশ্বকাপেই দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ এসেছিল তার সামনে। এবারও তিনি দলের অধিনায়ক। ব্যাটিং- বোলিং-ফিল্ডিং এবং ক্রিকেট বুদ্ধিমত্তায় সাকিব দলের চৌকষ খেলোয়াড়। গেল বিশ্বকাপে ব্যাট-বলে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছিলেন। এবার সেই ধারাবাহিকতা রাখতে পারলে বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বকাপে তাদের সেরা সাফল্য নিয়ে ফিরতে পারে।
লিটন দাস: ক্যারিয়ারের শুরুটা তেমন তার তেমন চমকপ্রদ কিছু ছিল না। কিন্তু যত সময় গিয়েছে নিজেকে দলে গুছিয়ে নিতে পেরেছেন লিটন দান। স্ট্রোকফুল ব্যাটসম্যান। ব্যাটিংয়ে যে কোনো পজিশনে ব্যাট করতে পারেন। কিন্তু ওয়ানডেতে এখন নিয়মিত ওপেনার হিসেবে খেলছেন। উইকেটকিপার কাম এই ব্যাটসম্যানকে সামনের সময়ে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অধিনায়ক হিসেবে ভাবা হচ্ছে। খুবই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। যেদিন খেলে দেন সেদিন দলের বাকিদের শুধু হাততালি দেওয়া ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। এটি লিটনের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ।
নাজমুল হোসেন শান্ত: অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত এখন দলে থিতু হয়েছেন। শুরুর বাজে ফর্ম কাটিয়ে উঠে তিনি এখন দলের প্রাইম ব্যাটসম্যান। তিন নম্বরে ব্যাট করেন। দলের ইনিংসের ভিত্তি গড়ার দায়িত্ব তার ওপর। ২৫ বছরের এই তরুণ এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তবে তিনি অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন। সা¤প্রতিক সময়ে ব্যাট হাতে দারুণ সময় কাটছে এই বাঁহাতি ক্রিকেটারের। সব সমালোচনাকে কিভাবে মাঠে বাইরে ফেলে এসে ২২ গজে মনোযোগ নিয়ে পারফর্ম করতে হয় তার একটা চমৎকার উদাহরণ তৈরি করেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত।
মুশফিকুর রহিম: বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। সেই ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বকাপে খেলছেন। ২৫১টি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এটি হতে যাচ্ছে তার ক্যারিয়ারের পঞ্চম ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ওয়ানডেতে ৯টি সেঞ্চুরির মালিক এই উইকেটকিপার কাম মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান। গেল বিশ্বকাপে ট্রেন্টব্রিজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন তিনি। যা বয়স তাতে এটি হতে যাচ্ছে সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। শেষ বিশ্বকাপ নিশ্চয়ই ব্যাট হাতে রাঙাতে চাইছেন মুশফিক।
তাওহীদ হৃদয়: তরুণ ক্রিকেটার। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন। এই বছরই তার আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে। ৯টি ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন। তবে এই ম্যাচগুলোতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন দলের মিডলঅর্ডারের ‘হৃদয়’ ঠিক রাখার দায়িত্ব বেশভালোই পালন করতে পারেন। ৯ ম্যাচে তিনটি হাফসেঞ্চুরি রয়েছে তার। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণের ক্রিকেটীয় মস্তিস্ক বেশ ধীরস্থির। পরিস্থিতি বুঝে খেলার দক্ষতা রয়েছে তার। পাঁচ নম্বর পজিশনে দক্ষ হাতে ব্যাটিং সামাল দিচ্ছেন তিনি।
তানজিদ হাসান তামিম:বয়স মাত্র ২২। বিশ্বকাপের আগেভাগে এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। মুলত নিয়মিত ওপেনার তামিম ইকবাল ইনজুরিতে থাকায় এই তরুণের জাতীয় দলে সুযোগ এসেছে। অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ইমার্জিং কাপেও খেলেছেন কিছুদিন আগে। পারফরমেন্সও মন্দ না। তরুণ এই ক্রিকেটারের ওপর নির্বাচকদের অনেক আস্থা। বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ আসরে প্রথমবারের মতো নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে সামনের সময়টা তার উজ্জ্বল।
শামীম পাটোয়ারি : লেট অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেন। সাতনম্বর ব্যাটিং পজিশন নিয়ে নির্বাচকরদের দুঃশ্চিন্তা কোনো শেষ ছিল না। অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বাদ দিয়ে তারা এই পজিশনের জন্য তরুণ ক্রিকেটারকে বেছে নিয়েছেন। শামীম পাটোয়ারির মধ্যে কম বলে দ্রুতগতিতে রান তোলার দক্ষতা আছে। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনি। ট্রফিও জিতেছেন। এবার বড়দের আসরে নিজেকে প্রমাণ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ তার সামনে। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের দলে ডাক পেয়েছেন। সেখানে ভালো করলে বিশ্বকাপের জন্য তার দরজা খুলে যেতে পারে।
মোহাম্মদ নাঈম : দলের তিন নম্বর ওপেনার হিসেবে তাকে ভাবা হচ্ছে। মুলত টি- টোয়েন্টি খেলোয়াড়। ঘরোয়া লিগে ওয়ানডেতে ভালো পারফর্ম করার সুবাদে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে খেলার সুযোগ এসেছে তার সামনে। তবে তামিম ইকবাল ফিট হয়ে দলে ফিরতে পারলে মোহাম্মদ নাঈমকে বিশ্বকাপের স্ট্যান্ডবাই তালিকায় চলে যেতে হতে পারে। বাঁহাতি এই ওপেনার সর্বশেষ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজের দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হন। এশিয়া কাপে যদি নিজেকে মেলে ধরতে না পারেন তাহলে বিশ্বকাপের দলে তার দরজাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
আফিফ হোসেন:টি- টোয়েন্টি আগে খেলেছেন। তবে ওয়ানডেতে অভিষেক হয়েছে ২০২০ সালের মার্চে। খেলেছেন মাত্র ২৮টি ম্যাচ। হাফসেঞ্চুরি তিন। রান সবমিলিয়ে ছ’শর নিচে। কিছুটা কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো স্পিনও পারেন। মাহমুদউল্লাহ’র শুন্যস্থানে যে ক’জন ক্রিকেটারকে নির্বাচকরা চিন্তা করছেন তার মধ্যে আফিফ হোসেন একজন। এশিয়া কাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। পারফর্ম করতে পারলে বিশ্বকাপে সাত নম্বর পজিশনের জায়গাটা নিজের করে নেওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে তার।
মেহেদি মিরাজ : সাকিব আল হাসানের পর দলে দ্বিতীয়সেরা স্পিন অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো প্রয়োজনে দলের ওপেনার হিসেবেও খেলতে পারেন। আবার লোয়ারঅর্ডারে ব্যাট করতে নেমে দলকে জেতানোর অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে সমান দক্ষ। অভিজ্ঞতার কোনো কমতি নেই। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দলের অধিনায়ক ছিলেন। গেল বিশ্বকাপে খেলেছেন। সা¤প্রতিক ফর্মও তার বেশ ভাল। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অন্যতম নিউক্লিয়াস ক্রিকেটার মেহেদি মিরাজ।
তামিম ইকবাল : বিশ্বকাপে খেলছেন সেই ২০০৭ সাল থেকে। নিজের খেলা সেই প্রথম বিশ্বকাপে তার সাহসী ব্যাটিং বাংলাদেশের ক্রিকেটের চেহারাই বদলে দিয়েছিল। এবারের বিশ্বকাপেও অধিনায়ক হিসেবেই তার খেলার কথা ছিল। কিন্তু ইনজুরির জন্য তিনি বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কিনা তা নিয়েই সংশয় থাকায় অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাড়ান। ফিটনেস ফিরে পেলে তামিম ইকবাল নিশ্চিতভাবেই থাকছেন এবারের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। লিটন দাসের সঙ্গে সঙ্গে তার ওপেনিং জুটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আশা-ভরসার অন্য নাম।
তাসকিন আহমেদ : ২০১৯ বিশ্বকাপের ঠিক আগেভাগে কেঁদেছিলেন তিনি। ইনজুরির কারণে সেই বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তার। চারবছর পর সেই তাসকিন আহমেদ আজ হাসছেন। বিশ্বকাপ আগেও খেলেছেন তাসকিন। ২০১৫ বিশ্বকাপে ৯ উইকেট শিকার করার অভিজ্ঞতা আছে তার। ইনজুরি কাটিয়ে তাসকিন এখন পুরোদুস্তর ফিট। পেস বোলিংকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন ডানহাতি এই পেসার। প্রতি ম্যাচেই শুরুতে ব্রেকথ্রু এনে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র এখন তাসকিন। অধিনায়কের কাছে তিনি অনেক বড় আস্থার নাম।
মুস্তাফিজুর রহমান : আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে মুস্তাফিজুর রহমানের শুরুটা হয়েছিল চমক দিয়ে। প্রতিপক্ষের কোনো বোলার তার বল বুঝতেই পারতেন না। তার স্লোয়ার, কার্টার এবং আড়াআড়ি সুইং ডেলিভারির রহস্য বুঝে উঠার আগেই ব্যাটসম্যানররা আউট! তবে শুরুর সাফল্যে ভাসা সেই মুস্তাফিজ মাঝে কিছুটা হারিয়ে গিয়েছিলেন। ৮৯টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই বাঁহাতি পেসার এবারের বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের অন্যতম সেরা সম্পদ। মুস্তাাফিজের সাফল্যের হাসিতে এই বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ আনন্দে ভাসুক।
হাসান মাহমুদ : তরুণ পেসার। ভীষণ শান্ত শিষ্ট। প্রতিপক্ষের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়েও যিনি উদযাপন আনন্দে ভীষণ ধীরস্থির। গতি খুব বেশি নেই। কিন্তু স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প বল করার দক্ষতা রয়েছে তার। ম্যাচের কঠিন পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে বল করার ওস্তাদি ক্ষমতা রয়েছে তার। ডেথ ওভারে এমন বোলারকেই পাশে চান অধিনায়ক। মাত্র ১৩টি ওয়ানডে ম্যাচে ২০টি উইকেট শিকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকাপের মতো আসরে হাসান মাহমুদ। ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপকে নিশ্চয়ই তিনিও স্মরণীয় করে রাখতে চাইবেন।
শরীফুল ইসলাম : অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের তারকা শরীফুল ইসলাম। বাঁহাতি এই পেসারের আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে ২০২১ সালে। তবে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষতার প্রমাণ রাখতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। তিন ফরমেটেই বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন তিনি। ১৭টি আর্ন্তজাতিক ওয়ানডেতে ২৭টি উইকেট শিকারি শরীফুলের কাছ থেকে এবারের বিশ্বকাপে বড় সাফল্যের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ দল। বোলিংয়ে ভীষণ তার আগ্রাসী মনোভাবই জানিয়ে দেয় সাফল্যে পেতে মরিয়া এই তরুণ।