সেই শূন্যতেই থমকে বাংলাদেশ!
এজিএমে জানা গেল নতুন অডিটর ঠিক করেছে বিসিবি। বিদেশি কোম্পানির স্বদেশি ফার্ম হাওলাদার ইউনুস এন্ড কোং-কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিসিবির হিসেব-পত্তর ঠিক রাখার দায়িত্ব তাদের। হিসেব তো ঠিক রাখতেই হবে। নইলে ডেবিট- ক্রেডিট মিলবে কিভাবে?
প্রশ্ন হলো গত দুই যুগে দেশের টেস্ট ক্রিকেটের হিসেব-নিকেশ কি কখনো মিলিয়েছে বিসিবি? ২৪ বছর ধরে টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো কি এই ফরম্যাটে পরিণত হতে পেরেছে?
দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অর্জন-বিসর্জন, আনন্দ- বেদনা, উন্নতি-অবনতি; ইত্যাকার বিষয়ের যথাযথ অডিট মেলানোর সময় যে হয়ে এলো। ২৪ বছর বয়সে এসে কেউ যদি নাবালকের মতো আচরণ করে তাহলে সেটা হাস্যকর শোনায়। মর্যাদা হারায়। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অমন নবিশি আচরণ ও শিশুতোষ ভুল এবং মানিয়ে নিতে না পারার ক্রমাগত ব্যর্থতায় এই ফরম্যাটে আমরা এখন, ‘ধুুর ওরা বাজে ছাত্র’; এই ব্র্যাকেটে পড়ে যাচ্ছি।
ব্যক্তিগত কৃতিত্বের কল্যাণে পেছনের দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ কখনো-সখনো মর্যাদাপূর্ণ শিরোনাম পেয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময় এর উল্টোপিঠ দেখেছে। ক্রিকেটে দিন শেষে সাফল্যের হিসেব হয় ফলাফল দিয়েই। আপনি যতই প্রক্রিয়ার গুনগান গান না কেন, নিক্তিতে সাফল্য যোগ না হলে সেই পরিশ্রম কেউ মনে রাখে না। টেস্ট ক্রিকেটের সেই অঙ্কে বাংলাদেশ একেবারে শুরুর সময় থেকে পিছিয়ে। আজ ২৪ বছর ধরে টেস্ট খেলে এসে আসার পরও সেই কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়াই রয়ে গেল!
পেছনের এই দুই যুগে আমাদের টেস্ট ক্রিকেটের হিসেবটা পরিস্কার-এই ফরম্যাটে অর্জনের তুলনায় অসাফল্যের ওজনটা বেশি। কিছু কীর্তি আছে। কেলেঙ্কারিও ছিল। কদাচিৎ কিঞ্চিৎ সুখ মিলেছে। তবে বেশিরভাগ সময় কেটেছে ব্যর্থতায়, বেদনায়।
কেন এবং কি কারণে এই মন্দা, সেই অডিট মেলানোর চেষ্টা কি করেছে কখনো বিসিবি? ২৪ বছরে ১৪২ টেস্টে হার ১০৫ টিতে। জয় মোটে ১৯ টেস্টে। ড্র ১৮ টি। তাতেও আবার বৃষ্টির কৃপা আছে বেশ! ক্রিকেটে সাফল্যের বিবেচ্য হিসেবে ধারাবাহিকতাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তুল্যমূল্যের নিরিখে লড়াই এবং জম্পেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই মূলত আমলে নেওয়া হয়। এই দুটো ক্ষেত্রেই পেছনের দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ ব্যর্থ, ভয়াবহভাবে ব্যর্থ! হ্যাঁ, সাফল্য এসেছে; তবে সেটা একটা-দুটো, কালেভাদ্রে। যা মোটেও স্থায়ী কিছু নয়। টেস্ট ক্রিকেটে লড়াইয়ের মাঠে বাংলাদেশের অবস্থা পুরোপুরি পাঞ্চিং ব্যাগের মতো। যে বেচারা প্রতিনিয়ত ঘুষি খেয়ে বিধ্বস্ত। টেস্ট অঙ্গনে বাকি সব প্রতিপক্ষ শক্তির তুলনায় এত বেশি পেশিবহুল যে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এদের সামনে বড্ড বেশি রোগা দেখায়। টেস্টে পা রাখার সেই শুরুর দিনগুলোতে বাংলাদেশ ম্যাচ পাঁচদিনে নিয়ে যেতে পারলেই মনে করা হতো অনেক কৃতিত্ব অর্জিত হয়েছে।
কি আশ্চর্য, ২৪ বছর পরে এসেও এখন সেই কৃতিত্বেই অনেক প্রাপ্তি ও সুখ খুঁজে বেড়ায় বাংলাদেশ দল! তাহলে আমরা কি সামনে এগোলাম নাকি যেখানে ছিলাম সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে?
অডিট করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
টেস্টে আমরা কেন ভালো করতে পারি না? এই প্রশ্নের উত্তরে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, মুমিনুল হক সবাই আজ আরেকবার বলছেন, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট ঠিক করতে হবে। আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে ভালো করার মূল প্রস্তুতির মঞ্চ দেশের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট। কিন্তু যে পরিবেশ পরিস্থিতি ও উইকেটে দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হচ্ছে, সেখানে যে মানের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে সেটা আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে মোটেও সাযুজ্যপূর্ণ নয়। খোদ ক্রিকেটাররাই এখন এ কথা বলছেন। এতদিন সাংবাদিকরা যখন এ কথা বলতেন তখন ক্রিকেট সংগঠকরা মনে করতেন, আরে ধুর, এরা তো সমালোচনা করবেই। এখন যদি তারা হুঁশে ফিরেন!
চট্টগ্রামে ১৯২ রানে হারা ম্যাচে মুমিনুল হক প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আপনার কাছে কি মনে হয় ফার্স্ট ক্লাস ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের মান সমান? আমি বুঝি কারণ আমি ৬১টা ম্যাচ খেলছি। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে তবে এটাই সত্যি যে আমাদের ফাস্ট ক্লাস ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে অনেক তফাৎ। আকাশ-পাতাল তফাৎ। এটা আমি আপনি সবাই জানে। এটা অজুহাত না এটাই সত্যি। ঘরোয়া ক্রিকেটে আমি অতটা চ্যালেঞ্জ ফেস করি না, যতটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেস করি।’
প্রস্তুতির মঞ্চটাই তো ঠিক নেই। আর তাই দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান বা সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পান না। এক মৌসুমে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি পেস বোলারের দিকে নির্বাচকরা ফিরেও চান না।
দুর্বল পরিকাঠামো। পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব। পরিচালনায় পেশাদারিত্বের সঙ্কট। নিজস্ব ক্রিকেট সম্পদ, মস্তিস্ক এবং তাদের শক্তি-সামর্থ্যর ওপর আস্থাহীনতা। দ্রুত ছাঁটাই। অতিরিক্ত বাছাই। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে অনাদার-অবহেলা। বছরব্যাপী প্রতিভা অন্বেষণের কার্যকর তাগিদের অভাব। সর্বোপরি ঘরোয়া ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচের মচ্ছব। ক্লাব কর্তাদের মর্জিতে আম্পায়ারদের আঙুল তোলার দাসত্বগিরি-এসব অনাচার ও কুপ্রথা আমাদের বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের সম্ভাবনাকে ক্রমশ শূন্য এবং ফোকলা করে দিচ্ছে।
দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে এখনো তাই সেই শূন্যতেই বসবাস!