‘জঘন্য ক্রিকেট’ এবং উত্তরণের প্রেসক্রিপশন
সিলেট টেস্টে ৩২৮ রানে হারের পর বিসিবি সভাপতি ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন কি বলেছিলেন তা আগে শুনি।
‘হার সমস্যা না। কিন্তু যেভাবে আমরা হেরেছি সেটাই সমস্যা। ক্রিকেটারদের মনোভাব, মানসিকতা এবং শট নির্বাচন ছিল জঘন্য। দেখতে কুৎসিত লেগেছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা বোধকরি এই ফরম্যাটে খেলতেই চাইছে না। আমাদের মনে আঘাত লেগেছে। খেলা দেখে মনে হয়েছে হার বা জয়ের ব্যাপারে ক্রিকেটারদের কোনো চিন্তাই নেই। টেস্টে এই ধরনের শটস নির্বাচন, এই ধরনের মানসিকতা মোটেও কার্যকর নয়।’
দলের বাজে পারফর্ম্যান্সের পর বিসিবি বসের কাছ থেকে এমন মন্তব্য নতুন কিছু নয়। তিনি খোলামেলা ভাবে ক্রিকেটারদের সমালোচনা করে থাকেন। তাদের যেমন সমর্থন দেন, ঠিক আবার সমালোচনায়ও ছাড়েন না। তাও আবার ভরা মজলিসে।
প্রশ্ন হলো এই সমালোচনায় ক্রিকেট দলের কি কোনো উপকার হয়। উত্তর জানতে হলে আপনাকে সিলেটের পরের টেস্ট চট্টগ্রামের দিকে তাকাতে হবে।
চট্টগ্রাম টেস্ট বাংলাদেশ হারে ১৯২ রানে রানে!
১৪২ টেস্টে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৯ জয়। ১৮ ড্র এবং ৭৩ ম্যাচে হার। যার বেশিরভাগ আবার ইনিংস পরাজয়। শতাংশের হার জানাচ্ছে বাংলাদেশ তাদের খেলা টেস্টের ৭৩ ভাগ ম্যাচ হেরেছে! অর্থাৎ প্রতি একশ ম্যাচের মধ্যে হারের ভাগই শতকরা হিসেবে ৭৩।
লাল বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই ‘লাল’ হয়ে উঠা নতুন কিছু নয়। পেছনের ২৪ বছরেও টেস্ট ম্যাচের ফলাফলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশ।
পারেনি, কারণ এই সমস্যা সমাধানের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থাই যে নিতে পারেনি বিসিবি। যা নিয়েছে তা হলো টোটকা পদ্ধতি। তাই সাময়িক উপশম হলেও টেস্ট ক্রিকেটে বোর্ড সভাপতির ভাষায় ‘জঘন্য অবস্থা’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশ।
টেস্ট ক্রিকেটে এই জটিল অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে স্পোর্টস বাংলাও সমাধানের পথ খুঁজেছে। সেই পাঁচ প্রেসক্রিপশন এখন যদি বিসিবি মেনে চলে।
১) টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আলাদা একটা ম্যানেজমেন্ট সেল গঠন করা প্রয়োজন। যার নাম হতে পারে টেস্ট সেল।
এর কাজ যা হবে: আমাদের সম্ভাবনাময় টেস্ট ক্রিকেটার কারা সেটা খুঁজে বের করা হবে এই সেলের কাজ। এই খেলোয়াড়রা যাতে বছর ব্যাপী দীর্ঘমেয়াদি ক্রিকেট খেলতে পারে সেটার ব্যবস্থা করা। দেশে-বিদেশে সব জায়গায় তারা যেন খেলতে পারে। এই সেলের ক্রিকেটারদের জন্য স্পেশালাইজড ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ক্রিকেটারদের পর্যায়ক্রমিক উন্নতি এবং ট্রেনিংয়ের মনিটরিং করবে এই সেল। কারো টেননিক্যাল সমস্যা থাকলে সেটারও সমাধান করতে হবে।
২) জাতীয় লিগের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। আটটা দল খেলে এখন। এই সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিকেএসপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ বিভাগ, বাংলাদেশ বিমানকে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
এর কাজ যা হবে: এই লিগের খেলা চলবে সারাবছর ব্যাপী। অর্থাৎ যে ক্রিকেট ক্যালেন্ডার আছে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সেই সময়জুড়ে এই লিগ চলবে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা এই ছয়মাসের সূচিতে অ্যাভেইলেভল থাকলে খেলবে, না থাকলে খেলবে না। কিছু লিগ কোনো মতোই স্থগিত বা বন্ধ করা যাবে না। সবগুলো ম্যাচ হবে স্পোর্টিং উইকেটে। সম্প্রতি সিলেট টেস্টের জন্য যেমন উইকেট তৈরি করা হয়েছিল তেমন উইকেটেই হবে এই লিগ। কোনো তক্তা বা র্যাঙ্ক টার্নার উইকেটে খেলা হবে না।
৩) ‘এ’ দল এবং অনুর্ধ্ব-২৩ দলের জন্য নিয়মিতভাবে সিরিজের আয়োজন করতে হবে।
এর কাজ যা হবে: দেশে-বিদেশে এদের খেলা চলবে বছরব্যাপী জুড়ে। এর জন্য বিসিবিকে বিনিয়োগ করতে হবে। ব্যাংকে টাকা জমা রেখে আপনি আয়েশের হাই তুলে কোনো লাভ নেই। সেই টাকার যথাযথ বিনিয়োগ করলে সেটাই আরো লাভ এনে দেবে। এখানে খরচ হবে। কিন্তু সেই খরচকে বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে হবে। দল ভালো করলে ক্রিকেটের বাজার মূল্য বাড়বে। যে স্পন্সর এখন ৬০ কোটি টাকায় বিক্রি হলো সেটা ১২০ কোটি টাকায়ও বিক্রি হতে পারে। ভারতে আজ ক্রিকেটের বাজার মূল্য এতো চড়া কেন। কারণ একটাই তাদের দলীয় পারফর্ম্যান্স।
এই দলের জন্য বছরে তিন থেকে চারটা সিরিজের আয়োজন করতে হবে। সেই সিরিজে ওয়ানডে, টেস্ট এবং টি- টোয়েন্টি সবই থাকবে। সব ফরম্যাটের ব্যাকআপ খেলোয়াড় যারা আছেন তারা এই সিরিজগুলোতে খেলবে।
৪) স্কুল পর্যায় থেকে তিনদিন বা চারদিনের ম্যাচের আয়োজন জোরদার করতে হবে। এখনো স্কুল ক্রিকেট হয়। কিন্তু সেটা করার জন্যই শুধু করা। বড় দৈর্ঘ্যরে ম্যাচে শেখার যে ধাপ সেটা স্কুল পর্যায়ের ক্রিকেট থেকে ক্রিকেটারদের মনে গেঁথে দিতে হবে।
৫) প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের সংখ্যা অবশ্যই বাড়াতে হবে। সারাবছর মাত্র ছয়টা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলে টেস্টের প্রস্তুতিটা হাস্যকর। পৃথিবীর অন্যান্য টেস্ট খেলুড়ে দেশ যেভাবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে মর্যাদা দেয়। যেভাবে জোর প্রতিযোগিতা নিয়ে মাঠে নামে। যেভাবে গুরুত্ব দেয়। সেভাগেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের আয়োজন করতে হবে। মনে রাখতে হবে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুতির মঞ্চই হবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট। অথচ আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে খোদ ক্রিকেটাররাই নাম দিয়েছেন- পিকনিক ক্রিকেট! এই অমর্যাদা সরিয়ে এটাকে পারফেক্ট ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মর্যাদা দিতে হবে। ক্রিকেটাররা যাতে এই ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই টেস্ট ক্রিকেটের ধাঁচের যথাযথ শিক্ষা নিতে পারেন-সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট লম্বা সময় ধরে অনুসরণ করে আসছেন ক্রিকইফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম। দক্ষ এই ক্রিকেট রিপোর্টারও বলেছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে গল্পটা সেই একই এবং পুরানো; এখানে প্রতিভা আছে, কিন্তু সেই প্রতিভার সঠিক প্রস্ফুটণ নেই। সংগঠকরা অহরহ ভুল করছেন। মিডিয়া, গ্যালারি এবং সমর্থকরা রাগ ঝাড়ছে। তুমুল সমালোচনায় ক্রিকেট বিদ্ধ হয়। আবার বাংলাদেশ একটা ম্যাচ জিতে এবং সঙ্গে সঙ্গে সবাই সবকিছু ভুলে যায়। আবার বাজেভাবে ম্যাচ হারে এবং ফের সেই সমালোচনা তেঁড়েফুঁড়ে উঠে; ট্যাগলাইন হয়-‘জঘন্য ক্রিকেট’!