ক্রো থেকে উইলিয়ামসন- বিশ্বকাপের টুর্নামেন্টসেরাদের গল্প

ক্রো থেকে উইলিয়ামসন- বিশ্বকাপের টুর্নামেন্টসেরাদের গল্প

 

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি শুরু ওয়ানডে ম্যাচের যাত্রা। ওয়ানডে ফরম্যাটের যাত্রা শুরুর চার বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো মাঠে গড়ায় ওয়ানডে বিশ্বকাপ। ১৯৭৫ সালের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দলের বরাদ্দ ছিল ট্রফি। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জন্য ছিল না কোনো পুরস্কার। পরের তিন আসরেও ছিল একই পুরস্কার। ব্যক্তিগতভাবে কোনো ক্রিকেটারই পাননি কোনো খেতাব।
সেই ধারাবাহিকতা বদলায় রঙ বদলের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো রঙিন পোশাকে মাঠে গড়ায় ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেবারই প্রথমবারের মতো তুলে দেওয়া হয় বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটারের পদক। সেমিফাইনালে বাদ পড়া নিউজিল্যান্ডের ব্যাটার মার্টিন ক্রোর হাতে ওঠে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার। বিশ্বকাপের প্রথম টুর্নামেন্টসেরা তিনি। ক্রোর পর আরও সাত ক্রিকেটার এই পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ আসরে এই পুরস্কার পান ক্রোর স্বদেশি ও বর্তমান রানার্সআপ নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার কেন উইলিয়ামসন। বিশ্বকাপের প্রতি আসরের সেরা ক্রিকেটারদের ওই আসরের পারফরম্যান্স তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

মার্টিন ক্রো (১৯৯২)
বিশ্বকাপের প্রথম টুর্নামেন্টসেরা ছিলেন মার্টিন ক্রো। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হওয়া ওই বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ৪৫৬ রান করেছিলেন এই ব্যাটার। নিউজিল্যান্ডকে সেমিফাইনালে তুলতে তার ছিল বড় ভ‚মিকা। যদিও সেমিফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ৪ উইকেটে হারে ক্রোর নিউজিল্যান্ড। দলকে ফাইনালে তুলতে না পারলেও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি।

সনাৎ জয়াসুরিয়া (১৯৯৬)
টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৫২৩ রান এসেছিল ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটে। সর্বোচ্চ ১৫ উইকেট নেন টেন্ডুলকারের স্বদেশি অনিল কুম্বলে। ব্যাটে-বলে তারা উজ্জ্বল থাকলেও দলকে জেতাতে পারেননি বিশ্বকাপ শিরোপা। ব্যাটে-বলে এত উজ্জ্বল ছিলেন না শ্রীলঙ্কার সনাৎ জয়াসুরিয়া। ব্যাট হাতে ২২১ রানের পাশাপাশি শিকার করেন ৭ উইকেট। এতেই টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার পান জয়াসুরিয়া। মূলত দলকে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যাটে-বলে সাফল্য এনে দেওয়ার কৃতিত্ব ছিল তার টুর্নামেন্টসেরা হওয়ার পেছনের মূল কারণ। দলের সাফল্যে অবদান রাখলেও বলার মতো ইনিংস খেলতে পারেননি জয়াসুরিয়া। তবুও তিনি ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার। জয়াসুরিয়া প্রথম টুর্নামেন্টসেরা ক্রিকেটার, যিনি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন।

ল্যান্স ক্লুজনার (১৯৯৯)
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ওই ওয়ানডে বিশ্বকাপেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক কিংবা উইকেটশিকারির হাতে যায়নি টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার। বরং মাঝ দিয়ে এই পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার ল্যান্স ক্লুজনার। টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠার মিশনে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে সেমিফাইনালেই থামে প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপযাত্রা। ওই যাত্রা পর্যন্ত প্রোটিয়াদের এগিয়ে যাওয়ার মূল নায়ক ছিলেন অধিনায়ক ক্লুজনার। তার ব্যাটে ছিল ২৮১ রান। পাশাপাশি বল হাতে নেন ১৭ উইকেট। ছিলেন টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। তার সাফল্যে দক্ষিণ আফ্রিকার যাত্রাটা ছিল সেমিফাইনালে। সেই কারণে ওইবার টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার নিজের করে নেন ক্লুজনার।

শচীন টেন্ডুলকার (২০০৩)
ক্রিকেট-ঈশ্বর শচীনের সেরা বিশ্বকাপ কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে হয়তো অনেকেই বলবেন ২০১১। কারণ, সেবার বিশ্বকাপ ট্রফি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। পরিসংখ্যানে অবশ্য তার জন্য সেরা বিশ্বকাপ আসর ছিল ২০০৩। সেবার ব্যাট হাতে এক আসরে ৬৭৩ রান করেন তিনি। এছাড়া বল হাতে নেন ২ উইকেট। দলকে ফাইনালে তুলতে বড় ভ‚মিকা ছিল শচীনের। যদিও ফাইনালে ঠিক জ্বলে উঠতে না পারায় ঘরে তোলা হয়নি বিশ্বকাপ শিরোপা। ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে না পারার আক্ষেপের মাঝে শচীনের জন্য ছোট্ট উপহার হয়ে এসেছিল টুর্নামেন্টসেরার এই পুরস্কার। এছাড়া টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন শচীন। ১৯৯২ সালে প্রথমবার টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের জন্য হাতে ওঠে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার।

গেøন ম্যাকগ্রা (২০০৭)
অস্ট্রেলিয়াকে হ্যাটট্রিক ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতানোর নায়ক এই অজি কিংবদন্তি পেসার। ক্যারিবিয়ান সাগরপাড়ে অনুষ্ঠেয় ওই আসরে ২৬ উইকেট নিয়ে ছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। প্রতি ম্যাচে আলো ছড়ানো গেøন ম্যাকগ্রা নিজের শেষ বিশ্বকাপে পেয়েছিলেন টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই আসরে প্রথমবার কোনো বোলার নিজের বোলিং পারফরম্যান্সের কারণে টুর্নামেন্টসেরা হন। আগের চার আসরে টুর্নামেন্টসেরা ক্রিকেটাররা ছিলেন হয় ব্যাটার কিংবা অলরাউন্ডার। এছাড়া ম্যাকগ্রাই প্রথম পেস বোলার হিসেবে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার নিজের করে নেন। ম্যাকগ্রা দ্বিতীয় টুর্নামেন্টসেরা ক্রিকেটার, যিনি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন।

যুবরাজ সিং (২০১১)
দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হন যুবরাজ সিং। এর আগে ২০০৩ সালে এই পুরস্কার জেতেন শচীন টেন্ডুলকার। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক কিংবা উইকেটশিকারি ছিলেন না যুবরাজ। তবে ব্যাটে-বলে নিয়মিত পারফর্ম করেছিলেন টুর্নামেন্টজুড়ে। ব্যাট হাতে ৩৬২ রানের পাশাপাশি বোলিংয়ে নেন ১৫ উইকেট। ছিলেন টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। দলের প্রয়োজনে বল কিংবা ব্যাট হাতে পারফর্ম করার সামর্থ্যরে কারণে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার জেতেন যুবরাজ। পাশাপাশি দলকে বিশ্বসেরা করার পেছনেও ছিল বড় ভ‚মিকা।

মিচেল স্টার্ক (২০১৫)
স্বদেশি গ্লেন ম্যাকগ্রার পর প্রথম বোলার হিসেবে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার নিজের করে নেন মিচেল স্টার্ক। সেটাও পেস বোলার হিসেবে। অস্ট্রেলিয়াকে পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা জেতাতে ২২ উইকেট নিয়ে বড় অবদান রাখেন মিচেল স্টার্ক। তার সমান ২২ উইকেট নিয়ে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। তবে দলকে শিরোপা জেতাতে পারেননি এই কিউই পেসার। ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন বোল্ট। অপরদিকে ফাইনালে আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন স্টার্ক। তাতেই টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন স্টার্ক। দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের টুর্নামেন্টসেরা হন এই পেসার।

কেন উইলিয়ামসন (২০১৯)
বিশ্বকাপের ১২তম আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন কেন উইলিয়ামসন। ব্যাট হাতে ৫৭৮ রান। সঙ্গে পকেটে ভরেন ২ উইকেট। নিউজিল্যান্ডকে ফাইনাল পর্যন্ত টেনে তুলতে তার ছিল বড় ভ‚মিকা। শুধু তাই নয়, ফাইনালেও কিউইদের বড় ভরসা ছিলেন এই উইলিয়ামসন। সব মিলিয়ে আসরজুড়ে ছিলেন উজ্জ্বল। তবুও দলকে উপহার দিতে পারেননি কোনো বিশ্বকাপ শিরোপা। ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে শিরোপার হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকে ঘরে ফিরতে হয় উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ডকে। তাসমানপাড়ের দেশটি শিরোপা জিততে না পারলেও টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন।

সম্পর্কিত খবর