মাঝের ব্যর্থতা ও ডটবলে পুনের ম্যাচে শূন্য বাংলাদেশ
শুরুটা ভালো। শেষটাও লাগসই। কিন্তু মাঝের পুরোটাই মন্দ। এই মাঝের সঙ্কটে পড়ে বাংলাদেশ পুনেতে ম্যাচ হারল। আর ভারতের ব্যাটিংয়ের শুরুটা ভালো হলো। মাঝেরটা দারুণ। ফিনিসিংটা চোখ জুড়ানো। এই আনন্দেই ভারত ম্যাচ জিতল ৭ উইকেটে। পুনের ম্যাচে সহজ এই জয়ে ভারতের সেমিফাইনালের স্বপ্নটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। অন্যদিকে চলতি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হারের হ্যাটট্রিক পুরো।
শেষের দিকে বিরাট কোহলি যেভাবে হেসেখেলে সেঞ্চুরির জন্য অপেক্ষা এবং আনন্দ নিয়ে ম্যাচ জিতলেন তাতে আরো একবার স্কোরবোর্ডে যথেস্ট সঞ্চয় না করার দুঃখ জমা হলো বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে।
পুনের এই উইকেটে ২৫৬ রান নিয়ে ম্যাচ জেতা যায় না। যেই মাঠে ৩০০ রানকে পার স্কোর মানা হয়, সেখানে ২৫৬ রানকে তো মামুলিই বলতে হয়। সেই মামুলি টার্গেট ভারত অতি সহজেই টপকে গেল। হাতে ৭ উইকেট ও ৫১ বল জমা রেখে। ভারতের চারে চার জয়। বাংলাদেশের চারে তিন হার।
অথচ এই ম্যাচ জমিয়ে তোলার যথেস্ট সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। শুরুর সঞ্চয় সেই ভিত্তিও দিয়েছিল। পুনে ম্যাচের আগে পেছনের তিন ম্যাচে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিতে নিদারুণ সমালোচনা শুনতে হয়েছে। ওই তিন ম্যাচে কোনোটিতেই ওপেনিং জুটি টেকেনি। বিশেষ করে তরুণ ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম শুরুর তিন ম্যাচেই ব্যর্থ। সর্বোচ্চ ১৬ রান এসেছিল তার ব্যাটে। পুনে ম্যাচে ব্যাট হাতে কিছু করতে না পারলে একাদশ থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা ঝুলছিল তার ঘাড়ে। সেই সমস্যা, সেই চাপ নিয়েই ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে নামেন তানজিদ। এবং এই ম্যাচেই খেললেন নিজের সেরা ইনিংস। ৪৩ বলে তার ৫১ রানের ইনিংসটা বিশ্বকাপে ‘নতুন জীবন’ দিল।
ক্যারিয়ারের প্রথম হাফসেঞ্চুরি। তাও আবার ভারতের সুসংগঠিত বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে। ৫ বাউন্ডারি ও ৩ ছক্কায় সাজানো তার ইনিংসটার একটা অন্য নাম আপনি দিতেই পারেন-সাহসী!
তবে স্পিনের বিরুদ্ধে তার দুর্বলতা একটু বেশি প্রমাণিত। কুলদীপ যাদবের বলে তার আউট সেই সত্যটা আরেকবার জানান দিল।
চোট থেকে সেরে না ওঠায় সাকিব এই ম্যাচে খেলতে পারেননি। তার জায়গায় অধিনায়কত্ব করেন নাজমুল হোসেন শান্ত। বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে অধিনায়কত্ব করার দিনটা ব্যাটসম্যান হিসেবে মোটেও উপভোগ করতে পারেননি তিনি। রবীন্দ্র জাদেজার স্পিন পেছনের পায়ে খেলতে গিয়ে বল ব্যাটে লাগাতে পারেননি শান্ত। ৮ রানে শেষ হয় বিশ্বকাপে তার অধিনায়কত্বের ব্যাটিং ইনিংস।
মেহেদি হাসান মিরাজকে নিয়ে এই ম্যাচেও পরীক্ষণে নামে টিম ম্যানেজমেন্ট। দলের স্বীকৃত মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যানদের ছাপিয়ে তাকে ব্যাট করতে পাঠানো চার নম্বরে। ব্যাটিংয়ের শুরু থেকে মেহেদি হাসান মিরাজ অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। লেগসাইডে মোহাম্মদ সিরাজের যে বলে গ্লান্স করতে গিয়েছিলেন সেটা ছেড়ে দিলে নিশ্চিত ওয়াইড হতো। মিরাজের ব্যাট ছুঁয়ে আসা বল বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে গোলকিপারের ভঙ্গিতে গ্লাভসে নেন উইকেটকিপার কেএল রাহুল। শেষ হয় ১৩ বলে মিরাজের কষ্টকর ৩ রানের ইনিংস।
লিটন দাস চলতি বিশ্বকাপে তার দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি তুলে নিয়ে যেভাবে খেলছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল তিন অংকের দেখা মিলছে। কিন্তু ৬৬ রান করার পর যে কায়দায় তিনি লং অফে সহজ ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরলেন তাকে বলে সফট ডিসমিসাল। এই উইকেটে কোনো ব্যাটসম্যান হাফসেঞ্চুরি করতে পারলে সেটাকে সেঞ্চুরিতে শেষ করতে না পারাকে ব্যর্থতা মানা হয়।
৭ বাউন্ডারিতে লিটনের ৮২ বলে ৬৬ রানের হাফসেঞ্চুরিকে সেই অভিযোগে অভিযুক্ত। তবে এই ম্যাচে ব্যাটসম্যান হিসেবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার ট্যাগ মার্ক লাগছে তাওহীদ হৃদয়ের নামের পাশে। ৩৫ বলে ১৬ রানের ইনিংসের কি ব্যাখ্যা তিনি দেবেন- সেটা জানার বড়ই আগ্রহ। যেসময় ব্যাট করতে এলেন তাওহীদ তখন একপ্রান্তে স্পিন এবং অন্যপ্রান্তে পেস আক্রমণের পরিকল্পনা বুনেছে ভারত। ওয়ানডে ম্যাচে টেস্ট স্টাইলের ব্যাটিং দিয়ে তাওহীদ হৃদয় আসলে কি চেয়েছিলেন সেটা মুশকিল! ৩৫ বল খেলে একজন মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান একটা বাউন্ডারিও মারতে পারলেন না-সেই নজিরও দেখল পুনের ম্যাচ।
মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটে ইনিংসটা নতুন করে সাজানো এবং ফিনিশ করার দায়িত্ব চাপলো। ঠিক যখন বিষ্ফোরক ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন ঠিক তখনই মুশফিক ৪৬ বলে ৩৮ রান করে ফিরে গেলেন। তবে বুমরার বলে পয়েন্টে যে দুর্দান্ত কায়দায় মুশফিকের ক্যাচটি নিলেন জাদেজা তাতে এই উইকেট তার নামের ঘরেই যাওয়া উচিত।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ যখন উইকেটে এলেন তখনো ইনিংসের ৭৬ বল বাকি। কিন্তু সঙ্গী যে সব লেজের সারির ব্যাটসম্যান। সেই জটিল সময়েও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আরেকবার প্রায় একাই লড়লেন। ইনিংসের শেষ ওভারে আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত যা খেললেন তাতে আরেকবার প্রমাণিত হলো, অভিজ্ঞতা অনেক বড় সম্পদ। ৩ ছক্কা ৩ বাউন্ডারিতে ৩৬ বলে তার ৪৬ রানের ইনিংস বাংলাদেশের স্কোরকে আড়াই’শর ঘরে নিয়ে গেল।
কিন্তু ভারতের শক্তিমান এই ব্যাটিং লাইনআপের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানোর জন্য বাংলাদেশের ২৫৬ রান সত্যিকার অর্থেই মামুলি হয়েই রইল। রোহিত শর্মা, শুভমান গিল, বিরাট কোহলি ও কেএল রাহুলের ইনিংস সেই সত্যতাই জানান দিচ্ছে।
পুনের এই ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সব অভিযোগ এসে পড়ছে মাঝের ব্যাটসম্যানদের ঘাড়ে। শুরুর ১০ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৬৩ রান তোলা দল কেন এমন তক্তা ব্যাটিং উইকেটে তিনশ’র ওপর স্কোর নিতে পারবে না- সেই প্রশ্ন কোচ এখন করতেই পারেন!
এই ম্যাচে বাংলাদেশ মূলত খেই হারিয়েছে ১১ থেকে ৪০ ওভারের সময়টায় কচ্ছপ গতির ব্যাটিংয়ে। ম্যাচের সবচেয়ে দীর্ঘ এই সময়টায় ৩০ ওভারে বাংলাদেশ তুলেছে মাত্র ১২৬ রান। ওভার প্রতি ৪.২ রান! এমন উইকেটে এই সময়টায় এতো কম রান- ব্যাটিং অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। ৫০ ওভারের ম্যাচে সবমিলিয়ে ১৫৯টি ডটবল খেলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। আরেকটু সংক্ষিপ্ত করে বললে এই ম্যাচে ২৬.৫ ওভার থেকে বাংলাদেশ কোনো রানই তুলতে পারেনি।
পুনের ম্যাচে ৭ উইকেটে হারের কারণ যে ওখানেই লেখা হয়ে যায়!