বিশ্বকাপের দল এবং নির্বাচকদের ভুল শট!

বিশ্বকাপের দল এবং নির্বাচকদের ভুল শট!

রাজনীতি প্রসঙ্গে একটা কথা বেশ চলনসই- ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই!’-কথাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গেও বেশ মিলে যায়। এখানে বাস্তবতা সরিয়ে রেখে কখন কী যে হয়- কিছুই বলার সুযোগ নেই। এবারের বিশ্বকাপের দলটাই দেখুন-উত্তর পেয়ে যাবেন।

গত ৩০ এপ্রিল আইসিসির কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে রেখেই সেই প্রাথমিক দলটা গড়েছিলেন নির্বাচকরা। এরপর সপ্তাহ দুই পেরোতেই কীনা তাদের ঘোষিত বিশ্বকাপ দলে নেই সাইফউদ্দিন! এমন কী স্ট্যান্ডবাই তালিকাতেও নয়! অথচ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সবশেষ সিরিজে ৪ ম্যাচ খেলে ৮ উইকেট নিয়েছেন এই পেসার, যা কীনা এই সিরিজে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারের কীর্তি।

তাকে বিশ্বকাপের জন্য বিবেচনা না করা হলেও তথাকথিত ‘অটোমেটিক চয়েজ’ হিসেবে এই দলে চলে এসেছেন অনেকেই। বিশ্বকাপ যেখানে গোটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা নির্ভর করে সেখানেই কীনা আবেগ আর নিজেদের খেয়াল খুশি মতো গড়েছেন দল। না হলে সাইফউদ্দিনের জায়গায় সুযোগ পাওয়া পেসার তানজিম হাসান সাকিব জিম্বাবুয়ে সিরিজে ২ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন মাত্র ১ উইকেট। সর্বশেষ বিপিএলে ১১ উইকেট নিয়েছেন তানজিম, আর সাইফউদ্দিন নিয়েছেন ১৫ উইকেট। ফরচুন বরিশালকে চ্যাম্পিয়ন করাতে ব্যাটে বলে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন।

শুধু বোলিংয়ে নয়, ব্যাটিংয়েও তিনি তানজিমের চেয়ে অনেক এগিয়ে!

তাহলে এমন নির্বাচনে প্রশ্ন তো উঠবেই। প্রশ্নটা উঠতেই প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ লিপু এলোমেলোভাবে যা বললেন-তা বুঝতে পারাটাও কঠিন, ‘দুটো চিন্তা ছিল। আমরা চেয়েছি বর্তমান ক্রিকেটারদের নিয়েই দল করা। আর একটা চিন্তা ছিল ইনজুরি থেকে ফেরা ক্রিকেটাররা, যেমন সাইফউদ্দিন কেমন করে, তা দেখা। আমাদের যে আস্থার জায়গাটা, সেখানে সাইফউদ্দিনের চেয়ে তানজিম একটু এগিয়ে ছিল। এ জন্য ওকে দলে রেখেছি। সাকিবকে শ্রীলঙ্কা সিরিজেও আমরা দেখেছি। তার একাগ্রতা, মাঠে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার চেষ্টা তাকে সাইফউদ্দিনের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে রেখেছে। সাইফউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম যে ডেথ ওভারে ইয়র্কার করা, সেটা ঘরোয়া ক্রিকেটে যেমন ছিল, তার চেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে।’

যুক্তিটা যে খোঁড়া তা ক্রিকেটের নবীন দর্শকও বুঝতে পারছেন। একইভাবে লিটন দাস কোন বিবেচনায় বিশ্বকাপ দলে, সেই প্রশ্নেও এলোমেলো উত্তর নির্বাচকদের। ব্যাপারটা দেখুন- শুধু অভিজ্ঞতা আছে; কিপিং করেন আর অনেক আগে দলের জয়ে কয়েকটা ম্যাচে ছিল অবদান-তার জোরেই কীনা চরম বাজে ফর্মে থাকার পরও লিটন বিশ্বকাপ খেলতে গেলেন।

নির্বাচকরা এখানে বড়ই উদার। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখানে আশায় বুক বাঁধছে এই ক্রিকেটার ফর্মে ফিরবেন। এখন একের পর ম্যাচে এলোমেলো শট খেলে আউট হলেও এই ক্রিকেটার রানে ফিরবেন বিশ্বকাপের মাঠে! হাস্যকর আর পক্ষপাতমূলক হলেও এমনই ভাবনা লিপু, রাজ্জাক আর হান্নান সরকারদের নির্বাচক প্যানেলের। এমন ঘটনা যদিও ক্রিকেট বিশ্বে আর হয়েছে কীনা সন্দেহ যে আশ্চর্য বিকল্প নেই এই অজুহাতে আপনি ভয়াবহ অফফর্মে থাকা একজন ব্যাটারকে পাঠিয়ে দিলেন বিশ্বকাপে!

যদিও জুনে শুরু হতে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে কথার ফুলঝুরি নাজমুল হাসান পাপনরা ছড়িয়েছিলেন অনেক আগেই। ২০২২ সালের অস্ট্রেলিয়ায় টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বিসিবি সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন সাফ বলে দিয়েছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এই বিশ্বকাপ (২০২২) না, আমাদের টার্গেট দু’বছর পরের বিশ্বকাপ।’

অথচ দেখুন, দু’বছর আগে বোর্ড সভাপতি এমন কথা বললেও একটা ক্রিকেটারের বিকল্প নেই তাদের হাতে। নাকি এমন অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে তারা অফফর্মে থাকা একজন খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপের টিকিট পাইয়ে দেওয়া জায়েজ করছেন?

নির্বাচকরা স্বপ্ন দেখছেন লিটন দাস যেন বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে তার ফর্মটা ফিরে পান! অথচ এটা তো সবাই জানে যে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট বা বিশ্বকাপের মঞ্চ কোনো ক্রিকেটারকে ফর্মে ফেরানোর জায়গা না। এখানে যারা দুর্দান্ত ফর্মে আছেন, যারা সেরাটা দিয়ে দলকে জেতাবেন, তারাই থাকবেন দলে। পাশের দেশ ভারতের দলটাই দেখুন-তারা আমাদের নির্বাচকদের মতো আবেগ আর পক্ষপাতের দরজা খুলে বসেননি বলেই লোকেশ রাহুল কিংবা শুবমান গিলের মতো বড় নামও সরিয়ে রেখেছেন!

আরেকটা ব্যাপার খুব করে চোখে লাগল সবারই-তাসকিন আহমেদ ইনজুরি নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপে! তিনি ফর্মে থাকা ক্রিকেটার সন্দেহ নেই। অভিজ্ঞতাও আছে বেশ। কিন্তু তার যে পাজরের চোট সেটা যে বিশ্বকাপের আগেই সেরে যাবে তার কোন গ্যারান্টি নির্বাচক এমন কী টিমের ফিজিও-ও দিতে পারেন নি! তারপরও তাসকিন দলে। এমন কী সহ-অধিনায়ক করেই দলে। অথচ তাসকিন কবে ইনজুরিমুক্ত হবেন, কবে ফিটনেস ফিরে পাবেন, কোন ম্যাচে মাঠে দেখা যাবে, কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই।

মজার ব্যাপার হলো এখানে নির্বাচকরা বল ঠেলে দিলেন বিসিবির কোর্টে। প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু জানান তাসকিনকে সহ-অধিনায়ক করার সিদ্ধান্ত, তাদের নয় বিসিবির, ‘দেখুন, এটা একটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট। এটা বিসিবির সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে যে তারা সহ-অধিনায়ক হিসেবে তাসকিন আহমেদকে নির্বাচিত করেছে। যদি না পারে তাহলে এটা বিসিবি অবশ্যই তাদের নজরে আনবে, এটা তাদের ব্যাপার। এখন আমি পরিষ্কার করে বলতে পারছি না, তবে অবশ্যই সেখানে যদি তিনি না খেলেন, অন্য কাউকে সে পদটি বা দায়িত্বটি দেওয়া হবে।’ 

কী বুঝলেন- তাসকিন আদৌ খেলতে পারবেন কিনা তার উত্তরই জানেন না প্রধান নির্বাচক। আর এই সিদ্ধান্তটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কীনা সেটিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচক যখন দায়িত্ব নিচ্ছেন না এমন অনিশ্চিত অবস্থায় থাকা একজন ক্রিকেটারকে কেন আর কী কারণে সহ-অধিনায়ক হিসেবে দলে রাখা-সেটি বোধহয় পরিস্কার করতে পারে একমাত্র বিসিবি।

লিটনকে অন্তর্ভুক্তির মতো হয়তো তাসকিনকে নিয়েও একটু আবেগের বেলায় ভেসেছে বিসিবি আর তাদের নির্বাচক প্যানেল। অথচ সাইফউদ্দিনের ব্যাপারটায় তারা চরম বাস্তববাদীই নন, অনেকাংশে যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। তানজিম হাসান সাকিব ও সাইফউদ্দিন- এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে গিয়ে নির্বাচকরা তানজিমকে নির্বাচন করলেন। কারণ সাইফউদ্দিনের চেয়ে নাকি একাগ্রতা, নিবেদন আর এফোর্ট-এসব বিষয়ের যোগফলে তানজিম এগিয়ে। অথচ জিম্বাবুয়ে সিরিজ যেটি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির মিশন ধরা হয়েছিল সেখানে ৮ উইকেট পেয়ে সিরিজ সেরা তাসকিন আহমেদ।  ঠিক তার সমান উইকেট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে বাদ সাইফউদ্দিন।

নির্বাচক লিপু তো অভিযোগের সুরে বলেই ফেললেন সাইফউদ্দিন যথেষ্ট ইয়র্কার করেননি! কিন্তু এটাও জানা দরকার যে ইয়র্কার করার জন্য অফফর্মে থাকা অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত কী সেই সময় পরামর্শ দিয়েছিলেন তাকে? তারচেয়ে বড় কথা ইয়র্কারই কি ব্যাটারকে আউট করার একমাত্র অস্ত্র? যে খোড়া যুক্তিতে সাইফউদ্দিনকে বাদ দেওয়া হলো তা নিয়ে আরও বড় করেই প্রশ্ন ওঠা জরুরী।

অথচ এই সাইফউদ্দিনকেই কীনা সাড়ম্বরে বিশ্বকাপের জন্যই প্রস্তুত করছিল বিসিবি। ইনজুরি কাটিয়ে তিনি ফিরে আসায় এক রাশ স্বস্তি ছিল কর্তাদের। কারণ সাইফউদ্দিন শুধু একজন পেস বোলারই নন, ব্যাট হাতেও বেশ দক্ষ। যেটা একজন পেসারের কাছে বাড়তি পাওনা। লেট অর্ডারে নেমে দু’শো স্ট্রাইক রেটে রান করার ব্যাটিং সক্ষমতা একাধিকবার দেখিয়েছেন তিনি। টি-টোয়েন্টিতে এমন একজন কার্যকর ক্রিকেটারকে বিশ্বকাপের ১৫ জনের দল থেকে আপনি বাদ দিলেন কিছু অন্তঃসারহীন যুক্তি দিয়ে। অথচ দলে না হোক ট্র্যাভেলিং রিজার্ভ খেলোয়াড় হিসেবেও সঙ্গী করা যেতো!

মনে কষ্ট পেলেও বিশ্বকাপ-গামী বাংলাদেশ দলের অফিসিয়াল ছবি পোস্ট করে বুধবার শুভেচ্ছা জানালেন সাইফউদ্দিন। এই ছবিটা অন্তত স্বস্তির। কারণ গত কয়েক বিশ্বকাপেই তো অফিসিয়াল এমন একটা ছবির হাহাকার ছিল। এবার এক ফ্রেমেই ধরা দিলেন বিশ্বকাপ মিশনের ১৭ ক্রিকেটার!

নির্বাচকরা বিশ্বকাপের দল নির্বাচনে একাধিক ভুল শট খেললেন। তাদের খোড়া যুক্তিতে দলে জায়গা পাওয়া ক্রিকেটাররা ঠিকঠাক শট খেলতে পারলেই সম্মান বাঁচে। না হলে যে আরও একটা ব্যর্থতার তদন্ত কমিটি গঠন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদিও গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ব্যর্থতার তদন্ত রিপোর্টই তো আলোর মুখ দেখেনি এখনো! কতো প্রশ্নের উত্তরও যে অজানা!

সম্পর্কিত খবর