৩৮২ রানের নিচে চূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন-সৌধ
খেলা তো শেষ বিরতির পরপরই।
বিরতি, মানে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস বাদেই। বাংলাদেশের ইনিংসের সময় অপেক্ষা রইলো কেবল একটাই-রানে জিতবে দক্ষিণ আাফ্রিকা। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সেঞ্চুরি ওই অবধারিত অপেক্ষাকে একটু দেরি করালো। সেই অপেক্ষা শেষ হলো বাংলাদেশ ইনিংসের ৪৬.৪ ওভারে। দক্ষিণ আফ্রিকা খেলা জিতলো ১৪৯ রানে। কিন্তু সম্ভবত বাংলাদেশ এই ম্যাচ হেরে গিয়েছিল আরো আগে; টস পর্বেই!
আগের দিন টসে জেতার জন্য দোয়া চেয়েছিলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। দুপুরে টসের কয়েন ছোঁড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এউউইন মার্করাম। সাকিব কল করেন। এবং ভুল কল। টসে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিং করলো। এবং যথারীতি ইনিংস শেষে যে রান তুললো তাকে আপনি ‘রান পর্বত’ নাম দিতে পারেন।
৫০ ওভারে ৩৮২ রান। তাও আবার মাত্র ৫ উইকেটে। এই বিশ্বকাপে বিশাল বিশাল রান তোলাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
উদাহরণ চান?
৪২৮, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা।
৩১১, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া।
৩৯৯, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড।
সর্বশেষ সেই তালিকায় যোগ হলো বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩৮২ রানের রান পাহাড়। অথচ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার শুরুটা ভালোকিছু হয়নি। পাওয়ার প্লেতে ২ উইকেট হারায় তারা। গোটা ম্যাচে বাংলাদেশের বোলিং সাফল্যেও আনন্দ বলতে ওই ক্ষুদ্রকণা। বাকিটুকু কেবল দুঃখের বেদনা। শেষের দিকে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশের বোলিং নিয়ে যা করলো তা আভিধানিক অর্থেই পিটুনি!
৪৫ ওভারে ৩০৯ রান করা দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ পাঁচ ওভারে সুপার সনিক গতিতে চারশ’র কাছাকাছি চলে যাবে, কে ভেবেছিল? হলো কিন্তু তাই। শেষ পাঁচ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা ৭৩ রান যোগ করল। আর শেষের ১০ ওভারকে তারা কার্যত টি-টেনই মেজাজেই ব্যাট চালাল। ইনিংসের শেষ ৬০ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার রানের ব্যালেন্সে যোগ হলো ১৪৪ রান।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই রানোৎসবে ব্যাট হাতে সবচেয়ে আনন্দময় পার করলেন কুইন্টন ডি কক। এবারের বিশ্বকাপ শুরুই করেছিলেন ডিকক সেঞ্চুরি দিয়ে। টানা পরের ম্যাচেও সেঞ্চুরি। তারপরের দুই ম্যাচে ব্যাটে কিছুটা রান খরা। সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বেছে নিলেন বাংলাদেশের বোলিং।
৪৭ বলে ৫০। ১০১ বলে সেঞ্চুরি। এরপরই তার ব্যাটে যেন ডিনামাইটের বিস্ফোরণ। নিজের খেলা পরের ৪৩ বলে করলেন আরো ৭৪ রান। যেখানে বাউন্ডারি ৯টি আর ছক্কা তিনটি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিজের আগের ১৬৮ রানের ইনিংসকে ছাড়িয়ে আরো দুরের স্বপ্ন দেখছিলেন ডি কক; জ্বি, ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন। যেভাবে খেলছিলেন তাতে নিশ্চিত সেই পথেই ছিলেন তিনি। কিন্তু থামতে হলো তাকে ১৭৪ রানে এসে। বাউন্ডারির দড়ির সামনে দাড়িয়ে নাসুম আহমেদ তার ক্যাচটা যখন নিলেন তখনো মনে হচ্ছিল মাঠ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না ডি ককের। তার চোখেমুখে এবং ড্রেসিংরুমে দিকের হাঁটার ভঙ্গিতে ডাবল সেঞ্চুরি মিসের দুঃখটা স্পষ্ঠ হয়ে উঠলো। স্কোরবোর্ডের দিকে একবার তাকালেন, তখনো যে ইনিংসের ২৯ বল বাকি!
ডি ককের ডাবল সেঞ্চুরি না পাওয়ার দুঃখটা ঘোচাল হাইনরিখ ক্লাসেন ও ডেভিড মিলারের শেষের ব্যাটিং। যে অবলীলায় তারা ছক্কা ও চার হাঁকালেন তাতে বাংলাদেশের বোলিংকে মনে হচ্ছিল শিশুতোষ লিলিপুট, আর দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং যেন গালিভার!
৮ ছক্কা, দুই বাউন্ডারিতে ৪৯ বলে ৯০ রানের ঝড় তোলেন ক্লাসেন। মাত্র তিনদিন আগে এই মাঠে ৬৭ বলে ১০৯ রানের ঝড় তুলেছিলেন ক্লাসেন। সেই একই গতিতেই বাংলাদেশের বোলিংকেও চুরমার করলেন। সঙ্গী ডেভিড মিলারও সামান্য সুযোগ পেয়ে ১৫ বলে অপরাজিত ৩৪ রান করলেন। যাতে ছক্কার মারই ৪টি।
সবমিলিয়ে পুরো ম্যাচে ২৬ বাউন্ডারি ও ১৯টি ছক্কা হাঁকায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ওভার প্রতি রান গড় ৭.৬৪। ওয়াংখেড়ের এই ওয়ানডেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পুরোদুস্তর টি- টোয়েন্টি বানিয়ে ম্যাচ জিতলো অনায়াসে ১৪৯ রানের বিশাল ভঙ্গিতে। একটু জানিয়ে দেই, ম্যাচে কুইন্টিন ডি কক করেছেন ১৭৪ রান। আর গোটা বাংলাদেশ দলের স্কোর ২৩৩।
এই ম্যাচে শক্তির পার্থক্য বোঝাতে আর কোনো উদাহরনের প্রয়োজন নেই!
চলতি বিশ্বকাপে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হার। প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বড় স্কোর। টানা চতুর্থ হার। ব্যাটে-বলে-আস্থায় এই ম্যাচ থেকে বাংলাদেশ দল হিসেবে কিছুই পায়নি। শুন্য, রিক্ত। প্রেসবক্সের স্কোরার যখন বাংলাদেশের ১০০ রান করার ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন সেটা কেবল ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছিলো। ২৭ ওভারের খেলা চলছে তখন, বাংলাদেশের ৬ উইকেট নেই। ব্যাটিং গুচ্ছের মধ্যে কেবল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ১১১ রানের ইনিংসটা আরেকবার জানান দিলো জেদ থাকলে লড়াই জেতা যায়। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে এই সেঞ্চুরিতে মাহমুদউল্লাহ দলের বড় হার এড়াতে পারেনি। কিন্তু জিতলেন একটা ব্যক্তিগত লড়াই। এই বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশ দল গত মার্চ থেকে যে পরিকল্পনা করেছিল, মাহমুদউল্লাহ সেই পরিকল্পনায় ছিলেন না। সেই মাহমুদউল্লাহ অনেক জটিলতার পর বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেলেন। সেঞ্চুরি করলেন। এখন পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানের ট্যাগ তার নামের পাশেই। তবে মাহমুদউল্লাহ যখন মাঠে সেঞ্চুরির আনন্দে ব্যাট তুলছেন তার অনেক আগেই যে এই ম্যাচে কে জিতছে- সেটা জানা হয়ে গেছে সবার। তখনো ম্যাচ জিততে বাংলাদেশের প্রয়োজন ১৬৯ রান, বাকি আছে ৩৪ বল!
থাক, সেই হিসেব কষে লাভ কি? এই ম্যাচের ফল তো জানা হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং ইনিংস শেষেই! ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের প্রবেশ দুয়ার থেকে হাঁটা দুরুত্বে মেরিন ড্রাইভ। পাশেই পুরো নিস্তরঙ্গভাবে বয়ে চলেছে আরব সাগর। কোনো গর্জন নেই, কোনো স্রোত নেই। বয়ে চলে, বয়ে চলে।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল এখন ঠিক তাই! থাকছে, খেলছে আর হারছে। কিন্তু সম্ভাবনা ক্রমশ শূন্য!