ডালাসের রোমাঞ্চকর থ্রিলারে বাংলাদেশের জয়
কি বলবেন একে? লো- স্কোরিং ড্রামা! ডালাস থ্রিলার! আসলেও তাই। শ্রীলঙ্কার ১২৪ রানের মামুলি সঞ্চয়ের জবাব দিতে নামা বাংলাদেশ ম্যাচ জিতলো ২ উইকেটে, তাও আবার একেবারে ১৯ নম্বর ওভারের শেষ বলে এসে! উইকেট এবং ওভারের এই হিসেবই জানাচ্ছে সামান্য পুঁজি নিয়েও দারুণ লড়েছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু অভিজ্ঞতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে নার্ভ ঠিক রেখে ম্যাচ বের নেওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২ উইকেটের এই নাটকীয় জয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হলো। আর টানা দুই ম্যাচে হেরে শ্রীলঙ্কা এখন বিশ্বকাপ থেকে প্রায় ছুটি হয়ে যাওয়া দলের তালিকায়!
টি-টোয়েন্টিকে বলা হয় চার-ছক্কার ঝড়। কিন্তু লো-স্কোরিং একটা ম্যাচও যে পরতে পরতে ক্রিকেটীয় আনন্দ-উত্তেজনার পরশ ছড়িয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নখ কামড়ানো রোমাঞ্চ-থ্রিলার উপহার দিতে পারে; তারই নজির হয়ে রইলো ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ।
ম্যাচের পাল্লা একবার শ্রীলঙ্কার দিকে হেলে। তো খানিকবাদে আবার বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের করে নেয়। যখন সেটা একপেশে হতে যাচ্ছে তখনই দেখা গেল আবার শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই ধাক্কা সামাল দিয়ে ধুলো মুছে ফের উঠে দাঁড়াল বাংলাদেশ। এই পুরো ম্যাচকে একটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো মনে হচ্ছিল। একবার শ্রীলঙ্কার দিকে হেলছে। আবার ফিরে আসছে বাংলাদেশের আঙ্গিনায়। এমন উত্তেজনার তুঙ্গে পৌঁছানো ম্যাচে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নার্ভ ঠিক রাখা। এই কাজে সবচেয়ে যিনি দক্ষ সেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আরেকবার দক্ষ হাতে ব্যাটকে হাল বানিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিলেন।
পাওয়ার প্লেতে ওপেনার কুশাল মেন্ডিসকে হারালেও শ্রীলঙ্কাকে শুরুতে এগিয়ে দিলেন আরেক ওপেনার নিশাঙ্কা পাথুম নিশাঙ্কা। ২৮ বলে ৪৮ রানের দারুণ কার্যকর ইনিংস খেললেন। ৯ ওভারে ৩ উইকেটে শ্রীলঙ্কার স্কোর তখন ৭০। এই স্কোর তখন হাসি ছড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কার ডাগআউটে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে গেল সেই পরিস্থিতি। দুই বলের ব্যবধানে আশালঙ্কা ও শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক হাসারাঙ্গাকে আউট করে শ্রীলঙ্কার ডাগআউটের হাসিটা বাংলাদেশ শিবিরে ফিরিয়ে আনেন লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন। ৯ রানের মধ্যে ১২ বলে মিডলঅর্ডারের এই উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা ব্যাটিং পিছলে গেল। আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। শেষের ৬ ওভারে তাদের জমা মাত্র ২৪ রান! শ্রীলঙ্কার ইনিংস থেমে গেল ১২৪ রানে। অথচ একসময় তাদের ব্যাটিং স্বপ্ন ছড়াচ্ছিল দেড়শ রান ছাড়ানোর।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংসও ম্যাচে প্রচুর উথাল-পাথাল দেখল!
রান তাড়ায় নেমে বাংলাদেশের শুরুটা হলো ভয়াবহ! সৌম্য সরকার এই ম্যাচেও আরেকবার ‘শূন্য সরকার’! তানজিদ হাসান তামিমও লঙ্কান পেসার নুয়ান তুষারার ফুলার লেন্থ সামাল দিতে পারেননি। জায়গায় দাড়িয়ে ব্যাট চালাতে গিয়ে সামান্য সুইং পাওয়া বলে বোল্ড হলেন। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত সংবাদ সম্মেলনে যে সময় দিচ্ছেন ব্যাট হাতে উইকেটে কিন্তু তাও না! লিটনকে তিনে জায়গা দিতে শান্ত ব্যাটিংয়ে চারে গেলেন। কিন্তু ফর্মে কোনো বদল নেই। পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারে যে কায়দায় আউট হলেন তা দেখে আপনি বলতেই পারেন- খামোখা আউট! শুরুর ৬ ওভারে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে রান মাত্র ৩৪ রান। উইকেট হারায় ৩টি। এই পর্যন্তই বোলিং পর্বে শ্রীলঙ্কার দাপটই থাকলো। পরের অংশে বাংলাদেশের ব্যাটিং সাফল্যের কাহিনী লিখল তাওহীদ হৃদয় ও লিটন দাসের জুটি। দুজনে মিলে দলকে নিয়ে গেলেন ৯১ রানে। ইনিংসের ১২ নম্বর ওভারে তাওহীদ হৃদয় যা করলেন তাকে বলে পাল্টা আক্রমণ। শ্রীলঙ্কার বোলাররা যাতে ম্যাচে চড়ে বসতে না পারে সেজন্য এই পর্যায়ে একটা সাহসী পরিকল্পনা নেন হৃদয়। আক্রমণে থাকা শ্রীলঙ্কান অধিনায়ককে টানা তিনটা ছক্কায় গ্যালারিতে ফেলেন। মূলত এই ওভারের ১৯ রানের কল্যাণেই বলের চেয়ে রানের সমীকরণ অনেক কমে যায়। তখন আর প্রতি ওভারে বিগ শটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলো না। বলে বলে রান নিলেই ম্যাচ জিতে যায় বাংলাদেশ। ৬৩ রানের সেই জুটি যখন ভাঙল তখন বাংলাদেশ ম্যাচ জয় থেকে মাত্র ৩৪ রান দুরে। ম্যাচ তো তখন বাংলাদেশের হাতের মুঠোয়।
একটু দাড়ান ভাই, এই ম্যাচ যে আরো অনেক নাটক জমিয়ে রেখেছে!
তিন ছক্কার সেই ওভারেই তাওহীদ হৃদয় আউট। ২০ বলে তার ব্যাটে ৪০ রানের ঝড়। স্ট্রাইক রেট পাক্কা ২০০। ৬৩ রানের জুটি ভাঙায় উইকেটে সেট হওয়া লিটন দাসও ছন্দ হারালেন। হাসারাঙ্গার পরের ওভারেই লিটনও ফিরলেন ৩৮ বলে ৩৬ রান তুলে। আউটের ভঙ্গিও একই, এলবিডব্লিউ। একপ্রান্তে সাকিব আল হাসান পরিস্থিতির দাবি মেটাতে ধৈর্য্য নিয়ে ব্যাট করছিলেন। জয়ের পথেই ছিলো বাংলাদেশ।
ম্যাচে ফের টুইষ্ট!
মাথিসা পাথিরানা তার শেষ ওভারে দ্বিতীয় বলেই সাকিবের উইকেট তুলে নিলেন। বলে বাড়তি বাউন্স দেখে সাকিব অফসাইডে পেরিস্কোপ শট বা গ্লাইড করার ভঙ্গিতে থার্ডম্যান অঞ্চল দিয়ে উড়িয়ে মারতে ব্যাট ছোঁয়ালেন। কিন্তু থার্ডম্যানে দাড়ানো থিকশানা সামনে এগিয়ে এসে মাটি থেকে ইঞ্চিখানেক ওপরে যে কায়দায় ক্যাচটা নিলেন সেটা বিস্ময় ছড়াচ্ছে। ক্যাচ হয়েছে কিনা- সেই প্রশ্নের জবাব জানতে সাকিবও বিস্মিত। থার্ড আম্পায়ার টিভি রিপ্লে দেখে জানালেন, ক্যাচটা নিখুঁত। ১৪ বলে ৮ রান করা সাকিবের এই আউটের পর খানিকটা এলোমেলো হয়ে পড়লো বাংলাদেশের ইনিংস।
ম্যাচ জিততে তখনো চাই ২২ বলে ১৬ রান। সহজই তো। তবে সেটা খানিকবাদেই যে কঠিনতম হয়ে গেল! নুয়ান তুষারা তার শেষ ওভারের তৃতীয় বলে বোল্ড করলেন রিশাদ হোসেনকে। পরের বলেই তাসকিনও গোল্ডেন ডাক মারলেন। রিভিউ নিয়েও এলবিডব্লিউ থেকে বাঁচতে পারলেন না।
এবার সত্যিকার অর্থেই বিপদে পড়লো বাংলাদেশ। ম্যাচ জিততে শেষ ১৪ বলে চাই ১২ রান। হাতে জমা ২ উইকেট। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে এসে যোগ দেন তানজিম হাসান সাকিব। ব্যাটিংয়ের বেসিক বেশ ভালোই জানা এই পেসারের। এই কড়া চাপের পরিস্থিতিতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দায়িত্বটা নিলেন। নিজের কাছেই বেশিরভাগ সময়ে স্ট্রাইক রাখার পরিকল্পনা করলেন।
ম্যাচ জিততে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন তখন দুটি ‘গুড বল’। সমস্যা হলো নুয়ান তুষারা ও পাথিরানার বোলিং কোটা ততক্ষণে শেষ। ১৯ নম্বর ওভার করতে এলেন দাসুন শানাকা। এই ম্যাচে সেটাই তার প্রথম এবং শেষ ওভার হয়ে রইলো। টেনশনের সেই ওভারে প্রথম বলটাই দিলেন শানাকা ফুলটস। মাহমুদউল্লাহ উড়িয়ে মারলেন। বল গ্যালারিতে, ছ..ক্কা! এই শটেই মুলত ম্যাচের পেন্ডুলাম আবার পুরোদুস্তর বাংলাদেশের দিকে চলে এলো। চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ শ্রীলঙ্কা হতাশ হয়ে ওভার থ্রোও করে বসলো। সেই অতিরিক্ত রানেই লেখা হয়ে গেল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ডালাস জয়ের গল্প!
আবার পুরো ম্যাচের দৃশ্যটা রিপিট করি।
স্লো এবং লো বাউন্সের এমন উইকেটে টসে জিতে আগে বোলিং নিয়ে কোনো বল হওয়ার আগেই এগিয়ে থাকলো বাংলাদেশ। কিন্তু প্রথম ১০ ওভারের ব্যাটিংয়ে লিডের ব্যাটন চলে গেল শ্রীলঙ্কার হাতে। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের মাঝের লড়াইয়ে ফের বাংলাদেশ এগিয়ে গেল। শেষ ছয় ওভারে শ্রীলঙ্কার ব্যাটারদের বেঁধে রাখলো বাংলাদেশ। ইনিংসের শেষ ২৯ বলে শ্রীলঙ্কার যোগাড় মাত্র ২৪ রান। অথচ এই দলটাই পাওয়ার প্লেতে তুলেছিল ৫৩ রান!
জয়ের জন্য ১২৫ রান তাড়ায় নেমে বাংলাদেশের দুই ওপেনার ও অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর সম্মিলিত সংগ্রহ মাত্র ১০ রান, তাও আবার ২১ বলে। নিঃসন্দেহে এই সময়ে নিয়ন্ত্রণ শ্রীলঙ্কার হাতে। চতুর্থ উইকেট জুটিতে লিটন দাস ও তাওহীদ হৃদয় ৬৩ রান জুড়ে বাংলাদেশকে ফের ম্যাচে ফেরালেন। এই জুটি ভাঙ্গতেই শ্রীলঙ্কা আবার স্বপ্ন দেখলো ম্যাচ জয়ের। খানিকবাদে সাকিব-মাহমুদউল্লার ব্যাটে ম্যাচ জয়ের সুখস্বপ্ন ফিরলো বাংলাদেশ শিবিরে। আবার তাতে বাধা। সাকিব, রিশাদ ও তাসকিনের উইকেট তুলে নিল শ্রীলঙ্কা মাত্র ৮ বলের ব্যবধানে। এই সময়ে বাংলাদেশের স্কোরে যোগ ৫ রান।
নাটকের পর্ব ও ক্লাইমেক্স ও অ্যান্টি ক্লাইমেক্স যেন শেষই হচ্ছে না!
দারুণ থ্রিলারের শেষ ক্লাইমেক্সটা টানলো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অভিজ্ঞ ক্রিকেট মস্তিস্ক। সব টেনশন দুর করে দলকে স্বস্তির জয় এনে দিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাট। ১ ছক্কায় ১৯ বলে তার অপরাজিত ১৬ রানের ইনিংস এই ম্যাচে বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকর ব্যাটিংয়ের মর্যাদা পাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২ উইকেটের এই জয়ে বাংলাদেশ চলতি বিশ্বকাপে সামনে বাড়ার পথে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন সমস্যার সমাধানটা করে ফেলল। জয় দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শুরু হলো। আর টানা দুই ‘বড় ম্যাচে’ হেরে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপে সামনে এগুনোর পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। নেপাল ও নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে বাকি দুই ম্যাচ তারা যদি জিতেও তবুও সুপার এইটে খেলার সম্ভাবনার নিক্তি অনেক অনেক নিচে!
ডালাসে এই ম্যাচ জয়ের কাজটা মুলত তৈরি করে দেয় বাংলাদেশের বোলাররা। প্রতিপক্ষকে ১২৪ রানে আটকে রেখেই ম্যাচ জয়ের শতকরা আশি ভাগ কাজ সুসম্মপূর্ণ করেন তারা। ইনিংস বিরতিতে পেসার তাসকিন আহমেদও বলছিলেন, ‘বোলিংয়ে ম্যাচ জয়ের অর্ধেক কাজটা হয়েছে। এখন ব্যাটিংয়ে বাকিটা সম্পূর্ণ করতে হবে আমাদের।’
তিন পেসার মুস্তাফিজুর, তাসকিন ও তানজিম সাকিব- তিনজনই দারুণ বোলিং করলেন। তাসকিন ২৫ রানে ২ উইকেট পান। মুস্তাফিজুরের ৪ ওভার সামাল দিতেই পারেনি শ্রীলঙ্কা। তার বোলিং বিশ্লেষণ ৪ ওভারে ১৭ রানে ৩ উইকেট, যাতে ডট বল ১৪টি। তবে বোলিং ক্যারিশমায় বাকিদের ছাড়িয়ে যান লেগস্পিনার রিশাদ হোসেন। ৪ ওভারে ২২ রানে তার শিকার ৩ উইকেট। বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচে এই দুর্দান্ত পারফরমেন্সই তাকে ম্যাচ সেরার মর্যাদা এনে দিয়েছে। রিশাদ এখন বলতেই পারবেন-এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম!
সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড:
শ্রীলঙ্কা: ১২৪/৯ (২০ ওভার) (নিসাঙ্কা ৪৭, ডি সিলভা ২১; মুস্তাফিজ ৩/১৭, রিশাদ ৩/২২, তাসকিন ২/২৫)
বাংলাদেশ: ১২৫/৮ (১৯ ওভার) (হৃদয় ৪০, লিটন ৩৬; তুষারা ৪/১৮)
ফল: বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী
ম্যাচসেরা: রিশাদ হোসেন