সাকিব ফুরোয়, আশা ফুরোয় না!
সমালোচনা ছাপিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাকিবের প্রত্যাবর্তনের সমাচার চলছে। একজন ক্রিকেট ভক্তকে গর্ব স্বরে লিখতে দেখলাম, ‘সাকিবরা ফুরোয় না’। এমন ভাব অনেকেই প্রকাশ করেছেন। আমরা অল্পতেই অতিষ্ঠ জাতি, অল্পতে তুষ্টও হই।
এ নতুন কিছু নয়। আমাদের ক্রিকেট সমর্থকরা মৌসুমি ফলের মতোই মৌসুমি সমর্থক। এদের আমের সময় আম, লিচুর সময়ে লিচু, তরমুজের সময়ে তরমুজই সবচেয়ে প্রিয় ফল। এদের গোলাপ বেলির পাশাপাশি সূর্যমুখীও বেশ পছন্দ, যখন সেটি ফুটে থাকে। যতক্ষণ আপনি পারফর্ম করবেন, এরা ততক্ষণ গুণগান গেয়ে উড়িয়ে ফেলবে। অন্যথায় আপনার শেষটাও এখানে দেখে নিবে।
আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা সম্ভবত এতে বেশ অভ্যস্ত, তাই তারা এসব গায়ে মাখেন কম। ম্যাচের পর ম্যাচ খারাপ খেললেও তাদের খুব একটা যায় আসে না। সাকিবতো আরও ড্যামকেয়ার। তবে নিজেকে ফিরে পাবার তাগিদে সাকিব যেন সবার আলাদা, নিজের ভুল থেকে দ্রুত শিখেন বলেই হয়তো সে সহজে জাত চেনাতে পারেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের চেয়েও সাকিবের ফিরে আসাটাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো!
সাকিবও যেন এসব ভালোই আঁচ করতে পারেন এবং সম্ভবত বেশ উপভোগও করেন। তা না হলে একদম সময়মত জ্বলে ওঠার আর কি রহস্য থাকতে পারে! ৪৬ বলে ১৩৯ স্ট্রাইকরেটে করলেন ৬৪,থাকলেন অপরাজিত! বল হাতে উইকেট শূন্য থাকলেও ইকোনমি ছিল সন্তোষজনক, ৪ ওভারে ২৯ রান,যেখানে ডট বল ছিল ১০ টি। খুব আহামরি কিছু করেছেন,তা নয়। তবে যে সময়ের মধ্যে যাচ্ছিলেন, তাতে এ পারফরম্যান্সতো মাথায় তুলে রাখার মতোই। যে সময়ের কথা বলছি, আদতে কি এমন খারাপ সময় পার করছেন? বিশ্বের বড় বড় সব ক্রিকেটারই লম্বা সময় ধরে ফর্মহীন কাটান, সে হিসেবে সাকিবকে খুব একটা ফর্মহীন বলা যাবে না। যদিও টি-টোয়েন্টিতে তে মোটাদাগে রান নেই দীর্ঘদিন।
তর্কের খাতিরে এবং সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স এর ভিত্তিতে (গতকালের ম্যাচ বাদ দিয়ে) ধরেই নিলাম সাকিব আল হাসান ফুরিয়ে গেছে। হ্যাঁ, ধরে নিলাম।
কিন্তু আমেরিকা বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে স্কোয়াড নিয়ে গিয়েছে, সে দলে যদি একটি নাম আপনি স্কোয়াড ঘোষণার আগ থেকেই জেনে থাকেন, সেটি নিঃসন্দেহে সাকিব আল হাসান। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের কথা বলা যেতে পারে, কিন্তু আদতে সেও সংগ্রাম করেই ফিরেছে। আমরা দ্রুত অতীত ভুলে যাই এবং অতি সাম্প্রতিক বিষয়ই আমাদের মগজে বেশি থাকে। তাই আমরা অনেকেই ভুলে গেসি, বাংলাদেশ দলের যে পঞ্চপাণ্ডবের কথা প্রচলিত আছে, সাকিব ছাড়া এদের প্রায় প্রত্যেকেই ভালো অপশন না থাকার কারণে সুযোগের পর সুযোগ পেয়েছেন।
অল্প সুযোগ প্রাপ্ত অন্যান্যরা ‘অনন্য’ পারফর্ম না করার সুবাদে তারা ‘বিশ্রাম’ কাটিয়ে দ্রুত দলেও ফিরেছেন। তারা যে ভালো ক্রিকেটার নন, তা বলছি না। আহামরি কখনও পারফর্ম করেননি, সেটাও বলছিনা। জাতীয় দলে যারাই যুক্ত হন তারা অবশ্যই নিজেদের প্রমাণ করেই সুযোগ পান এবং খেলেন। পারফরম্যান্সের তারতম্য বা ধারাবাহিকতা বোঝাতেই কিছু অপ্রিয় লাইন যুক্ত করা। যেমন অধিনায়ক কোটায় শান্তই কিন্তু প্রথম অটো চয়েস নয়, দেশ সেরা অধিনায়ক আনফিট মাশরাফিও ম্যাচের পর ম্যাচ দলে ছিল অদ্ভুত যুক্তিতে। তামিমের স্লো ব্যাটিং, ম্যাচের পর ম্যাচ ফর্মহীনতায়ও তাকে বাদ দেয়া যায়নি কেবলই একজন ভালো মানের ধারাবাহিক বাঁহাতি ওপেনারের অভাবে।
মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও কিন্তু লম্বা সময় ফর্মহীন ভাবেই দলে ছিল, মিডলঅর্ডারে যুতসই কেউ ধারাবাহিক না হওয়ায়। এখন যেমনটা লিটন দাস, সৌম্য, শান্তরা দলে আছেন। সাকিবের ক্ষেত্রে এরকম বলার খুব একটা সুযোগ নেই। নিয়মিত পারফর্ম করেছেন বলেই তিন ফরম্যাটে দীর্ঘদিন সেরাদের সেরা থাকতে পেরেছিলেন। এখন যখন লেখাটা লিখছি তখন সাকিব টি-টোয়েন্টিতে কয়েকধাপ নেমে ৫ম স্থানে আছেন।
হ্যাঁ, সাকিবের হেয়ালিপনা ছিল, হুটহাট সিরিজ না খেলার বাতিক ছিল। সেসব সিরিজে নতুনদের সুযোগ দেয়ার কথাও সে বলতো। কিন্তু ফিরে এসে সাকিব সেই ‘অটো’ চয়েসে রূপ নিয়েছে বারবার । এসব গল্প পুরনো। নতুন গল্প হচ্ছে সাকিবের শেষ দেখে ফেলা হচ্ছে। আমি সাকিবের শেষ না দেখলেও, শেষের শুরু দেখতে পাচ্ছি। গতকালের ম্যাচের আগে অনেকেই বলছে সাকিব ফুরিয়েছেন। আবার অনেকেই বলেছে সাকিব স্ব-মহিমায় ফিরবেন, অনেকটা ফিরেছেনও। আমার ধারণা ছিল হয়তো ফিরবে, হয়তো না। সাকিবের ফেরাটাতো অস্বাভাবিক না, কারণ সাকিব খেলাটা জানেন, বোঝেন এবং নিজের ভূমিকা পালনের সদিচ্ছা তার আছে। তাই তার ফেরাটাই সহজ ধারণা।
কিন্তু এ ফেরায় অথবা না ফেরায় আমি খুব একটা পার্থক্য দেখছি না সাকিবের শেষের শুরুতে। প্রায়ই বলি, সাকিব যতক্ষণ না চাচ্ছেন, ততক্ষণ তার শেষ বলে ফেলা কঠিন। স্বয়ং ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষেই কঠিন। আমাদের দেশীয় ক্রিকেটের যে ধরন, আমাদের যে সংস্কৃতি, এ-তেতো সাকিবকে বাদ দেয়ার সুযোগ কোনভাবেই নেই। সাকিব এর চেয়ে ঢের খারাপ খেললেও নেই। কিন্তু সাকিবকে বাদ দিতে যাবেও কেনো বোর্ড অথবা কোচ-অধিনায়ক ? তাদের কাছে এর চেয়ে ভালো অপশন কে আছে আর? নিকট ভবিষ্যতেও কি কেউ আসবে? আপাতদৃষ্টিতে এমনটা দেখা যাচ্ছে না। সত্যি বলতে আমি এ বিশ্বকাপ শেষেই সাকিব, মাহমুদুল্লাহর শেষ দেখতে ইচ্ছুক।
মাহমুদুল্লাহর কথা বলায় হয়তো হইচই পড়ে যেতে পারে, কেননা এখন আমাদের মগজে সবচেয়ে প্রিয় নাম এটাই, তাকে কেন শেষ করা লাগবে। শেষ করা লাগবে এজন্য যে, তারও শেষের শুরু হয়েছে। ক্যারিয়ারের একটা প্রান্তে গিয়ে আপনাকে থামা লাগবে, সাকিব আবার স্বরূপে ফিরলেও তাকেও সেই থামা নিয়ে দ্রুত ভাবা লাগবে। সাকিবের এই ফর্মে না থাকা নিয়ে আমার ছোট্ট একটা পর্যবেক্ষণ আছে। কেউ কেউ তার চোখের সমস্যার কথা বলছেন, তাতে হয়তো কিছুটা ভুগছেন, কিন্তু এটা খুব বড় কারণ না। মাঠে সাকিবকে যেমন দেখাচ্ছে, তাতে তাকে আনফিট মনে হচ্ছে না। বরং দলকে নেতৃত্ব দিতেই দেখা যাচ্ছে, উজ্জীবিত ও আত্মবিশ্বাসীই দেখাচ্ছে। টেকনিকেও সাকিব খুব একটা ভুগছেন, তাও মনে হচ্ছে না। কারণ এই লেভেলে আসলে অভিজ্ঞতাটাই হচ্ছে টেকনিক। আমি সাকিবের প্রস্তুতিতে ঘাটতি অনুভব করছি, পাশাপাশি মনঃসংযোগে।
পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব শতভাগ মনোযোগ দিতে পারছেন না, এটাই আমার বারবার অনুভব হচ্ছে। তার ব্যবসায়ীক পরিধির কথা আমরা জানি, সম্প্রতি জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন। বিশ্বকাপের জার্নিতে অন্যান্যরা নিশ্চিত সব কিছু বাদ দিয়ে একমাত্র ক্রিকেটেই মন দিয়েছে। সাংসদ সাকিবের কি এটা সম্ভব! মনে হয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে চর্চা,নিজের এলাকা থেকে একেবারে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার সুযোগ এখানে নেই। চাইলেও তা সম্ভব নয়, স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতে হয় সাংসদদের। এ জায়গায় সাকিব কিছুটা ঝামেলায় পড়েছে, যা সাকিবের সেরাটা দিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলে আমার ধারণা। মনোযোগ ভাগ হয়ে যাচ্ছে, চাইলেও সাকিব দ্রুত মাঠের খেলায় মনোযোগ ফেরাতে পারছেন না,পারলেও সেটা হয়তো ওঠানামা করছে।
ম্যাচ যত যাবে সাকিব ততই এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসবে বলে আমার ধারণা। সাকিব চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়, লড়াই করতে জানে। তাই তার ফেরাটা স্বাভাবিক, দ্রুত নিজেকে ফিরে পাওয়া সহজ। কিন্তু একই কারণ সমূহে এখন তার পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা আশা করা বোকামি হবে। এই একটি কারণেই সাকিবের শেষের শুরু করা উচিত বলে মনে করি। শুধু সাকিব কেনো, সবাই-ই একদিন ফুরোয়। বয়স,সময়, ইচ্ছা, প্রাধান্য সবসময় একই মাপকাঠিতে থাকে না। সাকিবও ফুরোবে,আমাদের আশা হয়তো ফুরোবে না, কারণ আমরা চাইবো সাকিব প্রতিনিয়ত সেরা হোক, সেটি তো আদতে সম্ভব নয়
সাকিব আমাদের সেরা তারকা,কিন্তু তারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা তাকেই সবার আগে অনুভব করা লাগবে। সেভাবেই তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া লাগবে। আপাতত এই বিশ্বকাপে সাকিব ধারাবাহিক থাকুক, এতে তার চেয়ে দলের লাভ বেশি। তারপর সাংসদ সাকিব দেশে ফিরে নিজেকে এক পরিচয়ে মেলে ধরুক, সেটিতেও সাকিবভক্তরা শুভেচ্ছা জানাবে নিশ্চয়ই।
লেখক - শরিফুল ইসলাম অপু
ক্রীড়া লেখক ও সংগঠক