ফাইনালের আগে আরেক ফাইনাল
ইউরো-২০২৪ এর শেষ ষোলো পর্যন্ত দলগুলোর খেলা যদি মূল্যায়ন করতে বলা হয়, তাহলে সবাই এটা মেনে নেবেন, যে এই ইউরোতে এখন পর্যন্ত সেরা দুটো দল হচ্ছে স্পেন এবং জার্মানি। টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি গোল করেছে জার্মানি, ২য় সর্বোচ্চ গোল করেছে স্পেন। আবার সবচেয়ে কম গোল হজম করেছে স্পেন, ২য় সর্বনিম্ন গোল হজম করেছে জার্মানি। শুধু এজন্যই কি তাদের লড়াইটাকে ফাইনালের আগে ফাইনাল বলা হচ্ছে?
না, বরং এই ম্যাচকে বলতে পারেন দুটো ফুটবল আইডেন্টিটি বা পরিচিতির লড়াই, দুটো ফুটবল প্লেয়িং স্টাইলের লড়াই। ফাস্ট অ্যান্ড ডিরেক্ট বনাম স্লো অ্যান্ড ইন্টিগ্রেট স্টাইলের লড়াই।
আশির দশক থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যারা জার্মানির খেলা দেখেছেন, তাদের কাছে জার্মানি মানেই ফাস্ট অ্যান্ড ডিরেক্ট পাওয়ার ফুটবল। বল ছাড়া অবস্থায় হয় হার্ডপ্রেসিং অথবা লো ব্লক ডিফেন্ডিং, আর বল পায়ে থাকলে ফিজিক্যাল স্ট্রাইকারদের উদ্দেশ্যে লং বল কিংবা দ্রুতগতির উইঙ্গারদের উদ্দেশ্যে লং বল, সেখান থেকে স্ট্রাইকারদের উদ্দেশ্যে ক্রমাগত ক্রসিং। যে কারণে জার্মানি থেকে তখন অত্যন্ত গতিসম্পন্ন উইঙ্গার এবং ট্র্যাডিশনাল স্ট্রাইকার উঠে আসতো। গার্ড মুলার, রুডি ভোলার, কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে, উলি হোয়েনেসের মতো ফুটবলারদের চাহিদা তখন ছিল প্রচুর। এছাড়াও তারা তখন বক্সের বাইরে থেকে প্রচুর শট করতো।
অন্যদিকে, স্পেনের ফুটবলারদের ফিজিক্যালিটি জার্মানির মতো না থাকায় তারা বল মাটিতে রেখে খেলতো বেশি, বল পজিশন নিজেদের কাছে রেখে খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো। তাদের খেলার ধরন ছিল স্লো অ্যান্ড ইন্টিগ্রেট। বুসকেটস, জাভি হার্নান্দেজ, জাভি আলোনসো, ইনিয়েস্তা, সেস্ক ফ্যাব্রিগাসদের মতো বল পায়ে ঐশ্বরিক রকম দক্ষ ফুটবলাররা গ্রাউন্ড ফুটবলে তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে স্পেনের বিজয়যাত্রা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু এই মেটামডার্ন ফুটবলে, যেখানে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কৌশলের, নতুন আইডিয়ার জন্ম হয়, কিংবা পুরনো কোনো কৌশলের নতুন রূপে ব্যবহার দেখা যায়, সেই কৌশলের বিপরীতে নতুন কোনো কৌশলের আবিষ্কার হয়, সেখানে তো শুধুমাত্র একটা খেলার ধরনেই আটকে থাকলে তো আর চলবে না, খেলোয়াড়দের খেলার ধরনের ওপর ভিত্তি করে সেখানে কিছু পরিবর্তন তো আবশ্যক। যে পরিবর্তনটা জার্মানিতে শুরু হয় ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের সময় থেকে, যার পূর্ণতা দেন জোয়াকিম লো। গেগেনপ্রেসিংয়ের গডফাদার রালফ রাংনিক ও তার শিষ্য বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে নিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা ইয়ুর্গেন ক্লপের প্রভাব জার্মানির জাতীয় দলে দেখা যায় ভালোমতোই।
টমাস মুলার, লুকাস পোডলস্কি, মেসুত ওজিলের পজিশনিং এবং স্পিড, সেইসাথে খেদিরা-শোয়েইনস্টাইগারের ওয়ার্করেট এবং বল প্লেয়িং অ্যাবিলিটির ওপর ভিত্তি করে লো জার্মানির খেলার ধরনে পরিবর্তন নিয়ে আসেন। ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির চিরাচরিত ট্রানজিশন হেভি পাওয়ার ফুটবলের সাথে যুক্ত হয় মুলার ওজিল পোডলস্কির আনপ্রেডিক্টেবল স্কিলফুল মুভমেন্ট। আবার ২০১৪ এর দিকে বোয়াটেং, হুমেলস, গুন্দোয়ান, টনি ক্রুসের মতো দুর্দান্ত বল প্লেয়ার দলে যুক্ত হওয়ায়, সুইপার কিপার রোলটাকে ম্যানুয়াল ন্যয়ারের রীতিমতো শিল্পে রূপ দেওয়ায় এবং জার্মান বুন্দেসলিগায় তখনকার বায়ার্ন মিউনিখ কোচ পেপ গার্দিওলার একটা প্রভাব দেখা দেওয়ায় জার্মান কোচ লো তার ট্যাকটিকসে যোগ করেন গ্রাউন্ড বেসড ফ্লুইড পাসিং ফুটবল। তারা ইচ্ছামতো তাদের খেলার গতি বাড়াতে এবং কমাতে পারতো। সেইসাথে গেগেনপ্রেসিং তো আছেই। জার্মানি তখন আর কোনো একমাত্রিক ধরনে খেলা দল না, যেটা ২০১৪ বিশ্বকাপে তাদের এতটা বিধ্বংসী হয়ে ওঠার পেছনের অন্যতম কারণ।
তবে এরপরের ৮ বছর জার্মানির যে অধঃপতন দেখা দেয়, তার পেছনের মূল কারণগুলো হচ্ছে, জোয়াকিম লোর শেষ সময়ে প্রেসিং ইনটেনসিটি কমে যাওয়া, নতুন খেলোয়াড়দের সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে না পারা, একই সাথে ২০১৪ সালের সেই ট্যাকটিকসেই আটকে থাকা।
২০০৮-১২ এই সময়কালে ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো উইনিং টিমের খেলার ধরন ছিলো টিকি-টাকা। কারণ সেই স্টাইল অনুযায়ী খেলার মতো ফুটবলার তখন দলে ছিল। ২০১৪ সালে এই সব খেলোয়াড়দের ফর্ম পড়তির দিকে যাওয়ায় এবং সেই মানের কোনো ফুটবলার না আসায় পরের ১০ বছর ভুগেছে স্পেন।
এবারে এই দুই দলের খেলার ধরন, তাদের প্লেয়িং ইলেভেন নিয়ে আলোচনা করি।
এই ইউরোতে জার্মানি তাদের চিরাচরিত ৪-২-৩-১ ফরমেশনে খেলেছে, যেখানে দুই ফুলব্যাক হিসেবে খেলেছেন জশুয়া কিমিচ (যিনি মাঝে একটা লম্বা সময় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলেছেন) এবং ম্যাক্সিমিলিয়ান মিটেলস্ট্যাট (ডেনমার্কের বিপক্ষে ম্যাক্সের পরিবর্তে খেলেছেন ডেভিড রাউম)। ডিফেন্সিভ মিডে ডাবল পিভটে খেলেছেন টনি ক্রুস আর বায়ার লেভারকুসেনের রবার্ট আনড্রিখ। নাম্বার টেন হিসেবে খেলেছেন ইলকায় গুন্দোয়ান, দুই উইংয়ে খেলেছেন দুই জেনারেশনাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার জামাল মুসিয়ালা এবং ফ্লোরিয়ান ভার্টজ (ডেনমার্কের বিপক্ষে তার পরিবর্তে খেলেছেন রাইট উইঙ্গার লেরয় সানে), আর স্ট্রাইকার হিসেবে খেলছেন আরেক অ্যাটাকিং মিডি, কাই হাভার্টজ। অনেকটা স্পেনের সেই ২০১০ সালের দলটার মতো মনে হচ্ছে না, যেখানে ৬ জন মিডফিল্ডারকে একই সাথে খেলিয়ে দিচ্ছেন কোচ!
হ্যাঁ। এই দলে ২ জন ডিপ লায়িং প্লেমেকার আর দুইজন নাম্বার টেনকে একত্রে খেলিয়ে দিয়েছেন জুলিয়ান। দুই উইংয়ে মুসিয়ালা আর ভার্টজ কিন্তু প্রথাগত উইঙ্গার না, তারা নাম্বার টেন। এখানে তাদের যে রোল দেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে উইং থেকে সেন্টারে চেপে হাফ স্পেসটা নিয়ন্ত্রণ করা, এই হাফ স্পেসে থেকেই প্রথাগত নাম্বার টেনের মতো করেই মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখা, যেই রোলটাকে বলা হয় মেজ্জালা। তাছাড়াও নাম্বার টেন হিসেবে থাকা গুন্দোয়ানকে ব্যবহার করেছেন শ্যাডো স্ট্রাইকার হিসেবে। তার ওয়ার্করেট মুসিয়ালা এবং ভার্টজকে তাদের রোল স্বাধীনভাবে পালন করতে সহায়তা করছে।
ডিপ লায়িং প্লেমেকার/রেজিস্তা হিসেবে খেলা টনি ক্রুসের সাথে খেলিয়েছেন রবার্ট আনড্রিখ কে, আরেক ডিপ লায়িং প্লেমেকার কিমিচকে তার পুরনো পজিশন রাইটব্যাকে খেলিয়ে তাকে ইচ্ছামতো ইনভার্ট এবং ওভারল্যাপ করার স্বাধীনতাও দিয়ে রেখেছেন। জার্মানির পাজলের মিসিং পিস ছিলেন এই আনড্রিখই, যিনি উপযুক্ত ডিফেন্সিভ সাপোর্ট দিয়ে ক্রুস এবং কিমিচকে তাদের মতো করে প্লে মেক করতে স্বাধীনতা দেবেন।
জার্মানি ফাস্ট ফুটবলই খেলছে, তবে সেটা গ্রাউন্ড, এয়ার দুই দিক দিয়েই। আবার মুসিয়ালা, ভার্টজ বল নিজেদের পায়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, যেজন্য তারা ইন বিটুইন দ্যা লাইনে পাস খেলছে প্রচুর। অর্থাৎ জার্মানির এই দলের খেলা হচ্ছে স্লো অ্যান্ড ইন্টিগ্রেট এবং ফাস্ট অ্যান্ড ডিরেক্ট ফুটবলের একটা দুর্দান্ত মিশ্রণ। পরিসংখ্যান যদি খেয়াল করেন, তাহলে এই কথার সত্যতা খুঁজে পাবেন। অপ্টা ফুটবল অ্যানালিটিক্সের মতে, জার্মানির গড় পজেশন ৬৫%, যা এই ইউরোতে সর্বোচ্চ। তারা মোট পাস খেলেছে ২৫৭৩ টি, যার মধ্যে ৯১.৬% ই সফল পাস। প্রতিপক্ষের অর্ধে সফল পাস দেওয়ার দিক দিয়েও তাদের হার শীর্ষে, ৮৭.৩%। তাদের এক্সপেক্টেড গোল ছিল ৭.৬৮, যেটা ৩য় সর্বোচ্চ। দুই উইং, হাফ স্পেস এবং জোন-১৪ এই তাদের ডমিনেশন সবচেয়ে বেশি।
এবার স্পেনকে নিয়ে আলোচনা করি। এই ইউরোতে স্পেন খেলছে তাদের চিরাচরিত ৪-৩-৩ ফরমেশনে, যেখানে মিডফিল্ডে আছেন রদ্রি, ফাবিয়ান রুইজ এবং পেদ্রি। স্ট্রাইকার অধিনায়ক আলভারো মোরাতার দুই পাশে দুই উইঙ্গার হিসেবে আছেন সময়ের অন্যতম সেরা দুই তরুণ উইঙ্গার লামিন ইয়ামাল এবং নিকো উইলিয়ামস।
রুবেন দে লা ফুয়েন্তের এবারের স্পেন দলকে অনেকটা জোসে মরিনহোর প্রথম দিকের চেলসি সেটআপের সাথে তুলনা করা হচ্ছে, যেখানে মিডফিল্ড ট্রায়ো রদ্রি, রুইজ, পেদ্রি এবং ম্যাকালেলে, এসিয়েন, ল্যাম্পার্ড ত্রয়ীর ফাংশন অনেকটা একই রকম, যদিও স্প্যানিশ মিডফিল্ডাররা এদের তুলনায় বেশ স্কিলফুল এবং মোবাইল।
তাদের লক্ষ্য থাকে দুই উইঙ্গার লামিন এবং নিকোকে বল দেওয়া, যারা নিজেদের স্কিলসেট কাজে লাগিয়ে সুযোগ তৈরি করবেন। ওই চেলসি দলে লেফটব্যাক অ্যাশলে কোল যেমন ওভারল্যাপ করে উইঙ্গার আরিয়েন রোবেনের সাথে যোগ দিতেন আক্রমণে, এখানেও লেফটব্যাক মার্ক কুকুরেল্লা ওভারল্যাপ করেন এবং নিকো কাট ইনসাইড করেন। এছাড়াও বক্সের বাইরে থেকে ক্রমাগত শুটিং তো আছেই।
এই স্পেন দল এখন আর আগের মতো নেই। তারা এখন বেশ ফাস্ট অ্যান্ড ডিরেক্ট ফুটবল খেলে থাকে। অপ্টা ফুটবল অ্যানালিটিক্সের মতে, স্পেনের গড় পজেশন ৯৫%, যা এই ইউরোতে ৪র্থ সর্বোচ্চ। তারা মোট পাস খেলেছে ২৪১৬ টি, যার মধ্যে ৯০.৫% ই সফল পাস। প্রতিপক্ষের অর্ধে সফল পাস দেওয়ার দিক দিয়ে তাদের হার ৮৪.৯%। তাদের এক্সপেক্টেড গোল ছিল ৮.৯, যেটা সর্বোচ্চ। স্পেনের আবার লেফট হাফ স্পেসে ডমিনেশন তুলনামূলক কম, দুই উইংয়ে তারা দুর্দান্ত।
আজ রাত ঠিক দশটায় জার্মানি এবং স্পেন মুখোমুখি হচ্ছে এই মহারণে। মুসিয়ালা-ভার্টজ কিংবা লামিন-নিকো, কারা হাসবে শেষ হাসি?
-অতিথি লেখক- সচ্চিদানন্দ পাল স্মরণ-শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ (২০১৮-১৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়