তীরধনুক ও একটি স্বপ্ন

তীরধনুক ও একটি স্বপ্ন

২০২০ সালের কোনো একসময়।

সাগর ইসলাম তখন স্কুল ছাত্র। বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছেন আর্চারি বিভাগে। সেই বছর টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের হয়ে আর্চারিতে অংশ নেন রোমান সানা। আর্চার রোমান সানা আর্চারি থেকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাছাই পর্বের বাধা টপকে অলিম্পিকে সুযোগ পান। অনেক বড় কৃতিত্বের ব্যাপার এটি। রোমান সানার এই কৃতিত্ব নিয়ে চারধারে বেশ হৈচৈ। ওয়াইল্ড কার্ডের বদান্যতায় সুযোগ না নিয়ে স্বীয় যোগ্যতার বলে বাছাই পর্বে জিতে সরাসরি অলিম্পিকে নাম লেখানো দ্বিতীয় বাংলাদেশি অ্যাথলিট আর্চার রোমান সানা। এই তালিকায় বাংলাদেশের প্রথম স্পোর্টসপার্সন হিসেবে কৃতিত্বটা ছিল গলফার সিদ্দিকুর রহমানের।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, মর্যাদাপূর্ণ এই তালিকার তৃতীয় বাংলাদেশি অ্যাথলিট সাগর ইসলাম!

সিদ্দিকুর রহমান, রোমান সানা ও সাগর ইসলাম-এই তিনজনই এখন ‘অলিম্পিকে বাংলাদেশ; এই ক্লাবের মর্যাদাপূর্ণ সদস্য। যারা বাছাই পর্বের চ্যালেঞ্জ জিতে সরাসরি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন।

সিদ্দিকুর এবং সানা দুজনেই অলিম্পিকের চুড়ান্ত আসরে অবশ্য তেমন বড়কিছু করতে পারেননি। কিন্তু গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের এই আসরে সরাসরি খেলতে পারার যোগ্যতা অর্জনও নেহাৎ চাট্টিখানি কথা নয়।

এবারের প্যারিস অলিম্পিকে ১৮ বছর বয়সী তরুণ উদ্যমী আর্চার সাগর ইসলামের সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সেই প্রসঙ্গে সাগর বলছিলেন, ‘আমি তখন মাত্র বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছি। রোমান সানা ভাই সেই বছর টোকিও অলিম্পিকের বাছাই পর্বের চ্যালেঞ্জ জিতে অংশ নিচ্ছেন। চারদিকে শুধু সানা ভাইয়ের নাম। সবাই তার প্রশংসা করছে। ঠিক তখনই আমার মনেও স্বপ্নটা দোলা দেয়, আচ্ছা আমাকে নিয়েও তো এমন কিছু হতে পারে! স্বপ্ন দেখার শুরু মুলত তখনই। আমিও একদিন অলিম্পিকে যাবো।’

মাত্র চার বছরের মধ্যেই সাগরের সেই স্বপ্ন পুরুণ হয়েছে। পেছনের এই চারবছরে কখনোই স্বপ্নছাড়া হননি বলেই আজ সাগর প্যারিস অলিম্পিকে মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করছেন।

এবারের অলিম্পিকে সবমিলিয়ে বাংলাদেশের পাঁচজন অ্যাথলিট অংশ নিচ্ছেন। আর্চারিতে সাগর ইসলাম, সাঁতারে সোনিয়া খাতুন ও সামিউল ইসলাম রাফি, শুটিংয়ে রবিউল ইসলাম ও অ্যাথলেটিক্সের স্প্রিন্টে ইমরানুর রহমান।

সেই ১৯৮৪ সালের লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে প্রথমবার অংশ নেয় বাংলাদেশ। সেই থেকে প্রতিবারের অলিম্পিকেই বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে। তবে অলিম্পিক পদক লড়াইয়ের ধারে কাছে নেই বাংলাদেশ। প্রথম হিটেই বিদায়। প্রতিবারই অংশগ্রহণকারী দল হিসেবেই বাংলাদেশের অলিম্পিক শেষ হয়।

২০১৪ সালের ব্রাজিলের রিও ডি জেনোরির অলিম্পিকের আগের অলিম্পিকগুলোতে বাংলাদেশ ওয়াইল্ড কার্ডের বরাতে অলিম্পিকে অংশগ্রহনের সুযোগ পায়। কখনোই বাছাই পর্বের বাধা ডিঙ্গিয়ে সরাসরি যোগ্যতার গুনে খেলার সুযোগ হয়নি। সেই ধারা বদলে দেন প্রথমে গলফার সিদ্দিকুর ২০১৪ সালে। তারপর আর্চার রোমান সানা ২০২০ সালে। আর এবার ২০২৪ এর প্যারিস অলিম্পিকে আরেক আর্চার সাগর ইসলাম। তারা প্রত্যেকেই বাছাই পর্বে জিতে র‌্যাঙ্কিং বাড়িয়ে সেই কৃতিত্বেই অলিম্পিকের আসরে খেলেন। কারো দয়া-দাক্ষিণ্যে না।

সাগর গত জুনে তুরস্কে আর্চারি বিশ্বকাপের স্টেজ -৩ এ পুরুষদের একক রিকার্ভ ইভেন্টের সেমিফাইনালে নাম লেখান। আর এটাই তাকে প্যারিস অলিম্পিকের এই ইভেন্টে সরাসরি খেলার সুযোগ করে দেয়।

তরুণ এই আর্চার নিজের স্বপ্ন পুরুণ প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘আমার আত্মবিশ্বাস ছিল বাছাই পর্বেই আমি উতরে যাবো। কোচকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, আমার ফোকাস যাতে ছুটে না যায়, সেজন্য তিনি আমাকে দারুণ সহায়তা করেছেন।’

মাত্র তিন বছর বয়সে সাগর বাবাকে হারান। চার ভাই-বোনকে মা একা হাতেই গড়ে পিঠে এতদুর নিয়ে এসেছেন। ছোট্ট চায়ের দোকান আছে তার মা’র। আর্থিক টানপোড়েন এখন কিছুটা কেটেছে সাগরের। অলিম্পিকের বাছাই পর্বের বাধা টপকে যাওয়ার পর স্পন্সর প্রতিষ্ঠান তাকে পুরুস্কৃত করেছে।

প্যারিস অলিম্পিকে একক রিকার্ভ ইভেন্টে সবমিলিয়ে ৬৪ জন আর্চার বাছাই পর্বের বাধা টপকে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই এর আগে অলিম্পিকের পদক জিতেছেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এই ইভেন্টে বিশ্বরের্কড গড়া আর্চারও রয়েছেন এবার সাগরের সঙ্গে প্রতিযোগির তালিকায়। এদের সবার বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হবে।

সাগর ইসলামের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।

সম্পর্কিত খবর