অসহায় আত্মসর্মপণ, বিশ্বকাপ বললো ‘বাংলাদেশ বিদায়’
গলা পর্যন্ত ডুবেছিল দল। নাক অব্দি ডুবল পাকিস্তানের কাছে হেরে। কলকাতায় দু’দিন আগে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে মর্যাদার কানাকড়ি হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার পাকিস্তানের কাছে ৭. উইকেটের হারে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের পুরোদস্তুর কর্পদকশূন্য দল। বিদায়ঘণ্টা আগেই বেজেছিল। কিন্তু অতি ক্ষুদ্রতম একটা গাণিতিক সম্ভাবনা বিশ্বকাপের মঞ্চে জিইয়ে রেখেছিল বাংলাদেশকে। মঙ্গলবার রাতে সেই হিসাবও বরাবর হয়ে গেল; আপনি এখন ঘোষণা দিতেই পারেন, বিশ্বকাপ থেকে বিদায় হয়ে গেছে বাংলাদেশের।
টুর্নামেন্টের বাকি দুই ম্যাচে বাংলাদেশ এখন কেবল নেহাৎ অংশগ্রহণকারী অন্য দল! ৭ ম্যাচে ৬ হার। তাও আবার টানা হার! শেষ কবে কোথায় কোন টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ টানা এতো ম্যাচ হেরেছিল, ঠিক স্মরণে আসছে না।
ম্যাচে হারে অনেকেই। তবে এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে অর্ধডজন ম্যাচে হেরেছে, তার কোনোটিতেই কোনোসময় কখনোই ম্যাচ জয়ের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি। ঠিক যাকে বলে একতরফা হার। অসহায় আত্মসর্মপণ। ধর্মশালায় নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে এমন হারের সঙ্গে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পরিচয়, সেই পরিচয় আরো জগদ্দল হয়েছে ক্রমশ। চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ড, পুনেতে ভারত, মুম্বাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, কলকাতায় নেদারল্যান্ড এবং পাকিস্তানা-সবার কাছে হার। এবং নরম সহজ হার। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, প্রতিযোগিতাহীন, ছন্নছাড়া ব্যাটিং-বোলিংয়ে অভাবী টাইপের ক্রিকেট খেলে শূন্যহাতে বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের বিদায়।
এই বিশ্বকাপের সেরা দল কে হবে সেটা জানতে ১৯ নভেম্বর ফাইনাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এখন এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বাজে দল কোনটা? বিশ্বকাপ কুইজের এই উত্তরের ঘরে শতকরা শতভাগের জবাব যা হবে তা বেশ জানা; বাংলাদেশ!
প্রতিটি ম্যাচেই ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ের একই করুণ চিত্র। মঙ্গলবার কলকাতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচেও সেই মঙ্গলময় কিছু ঘটলো না!
দুপুরে টসে জিতে ব্যাটিং বেছে নিলেন সাকিব আল হাসান। যথারীতি এবারো ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম গা গরমের আগেই বিদায়। শূন্য রানে শেষ তার ইনিংস। ওয়ানডাউনে নাজমুল হোসেন শান্ত এলেন আর গেলেন। চলতি বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে একটা হাফসেঞ্চুরি পেয়েছিলেন তিনি। তারপর ছয় ম্যাচের প্রতিটিতেই সিঙ্গেল ডিজিটে আাউট। এর মধ্যে আবার আছে দুটো শূন্য রান।
এই ম্যাচে মুশফিকও পারলেন না। ২৩ রানে ৩ উইকেটের দল হয়ে গেল বাংলাদেশ। সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও লিটন দাস দলকে টেনে তুললেন। চতুর্থ উইকেট জুটিতে যোগ হলো ৭৯ রান। মাহমুদউল্লাহ আরেকবার জানালেন এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। এই ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে পাঁচ নম্বরে প্রমোশন পেয়ে মাহমুদউল্লাহ ৭০ বলে খেললেন ৫৬ রানের ইনিংস।
শুরুর ১০ ওভারে ৩ উইকেটে ৩৭ রানের দল পরের ৩০ ওভারে পৌছাল ১৮৮ রানে। মাঝের এই অর্জনের কৃতিত্ব মাহমুদউল্লাহ, সাকিব ও শেষের দিকে মিরাজের। লিটন দাস ইনিংস বড় করার প্রাথমিক কাজ শেষ করেও যে কায়দায় আউট হলেন তাতেই তার এই ম্যাচে সব কৃতিত্ব চাপা পড়ে যাচ্ছে। ৬৪ বলে ৪৫ রান তোলা একজন ব্যাটসম্যান উইকেটে পুরোদুস্তর সেট হয়ে কেন অমন সফট কায়দায় আউট হবেন? ক্যাচটা তুলে দিয়ে লিটন দাসও উইকেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সম্ভবত নিজেকে সেই প্রশ্নই করছিলেন! মাহমুদউল্লাহ এই ম্যাচেও বোঝালেন জেদ- জোশের সঙ্গে প্রতিভা এবং অভিজ্ঞতার সংমিশ্রন ঘটালে সফল হওয়া যায়। তবে ক্রিকেট দলীয় খেলা। এখানে কারো ব্যক্তিগত সাফল্যে দল ছোট লড়াই জিততে পারে, কিন্তু ম্যাচ জিততে হলে দলীয়ভাবে সফল হতে হবে। সেই ব্যর্থতায় পাকিস্তান ম্যাচেও পর্যদুস্ত বাংলাদেশ।
শাহীন শাহ আফ্রিদি তার দ্বিতীয় স্পেলে এসে রাউন্ড দ্য উইকেটে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে ফেরালেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। উইকেটে তখনো লড়ছিলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। রান তুলতে তার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল এই ম্যাচ দিয়েই বিশ্বকাপ ব্যাটিং ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠছেন তিনি। তবে ৬৪ বলে তার ৪৩ রানের ইনিংস জানান দেয়, নখ দিয়ে পাহাড় কাটছেন সাকিব! এমনই কষ্টের ব্যাটিং! অধিনায়কের এই কষ্ট পুরোমাত্রায় সফল হতো যদি তিনি ইনিংসের শেষ পর্যন্ত থাকতে পারতেন। ঠিক যখনই হাতখুলে খেলার কথা, তখনই সাকিব রউফের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে আউট। এবং সেই সঙ্গে এই ম্যাচে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহের সম্ভাবনারও মৃত্যু!
মাঝের দুই ম্যাচে বাদ পড়ে তাওহীদ হৃদয় এই ম্যাচের একাদশে জায়গা পান। তবে বড় মঞ্চে এখনো অনেক স্থিরতা আর ধীমান মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয়তা যে রয়েছে তাই জানান দিয়ে তিনি ড্রেসিংরুমে ফিরলেন চটজলদি। ছক্কা হাঁকানোর পরের বলেই আবার কেন মারতে হবে? ব্যাটিংয়ে ‘গ্যালারি শো’ করতে গিয়ে বড়কিছু করার সম্ভাবনা খোয়ালেন তিনি।
মেহেদি মিরাজ অনেকদিন পরে আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩০ বলে ২৫ রান তুলে একটু অসময়ে আউট হলেন। লেজের সারির ব্যাটসম্যানদের জন্য পাকিস্তানের পেসাররা একটু বেশিমাত্রায় ‘শক্তিমান’ ছিলেন। শেষ তিন উইকেট বাংলাদেশ হারায় মাত্র ৪ রান যোগ করে, ১২ বলের ব্যবধানে। অলআউট ২০৪ রানে, তখনো কোটার ২৯ বল বাকি। ওয়ানডে ম্যাচে পুরো ৫০ ওভার খেলতে না পারাটা নেহাৎ ব্যর্থতা না, অযোগ্যতা!
বাংলাদেশের এই ‘অযোগ্য ও অসুন্দর’ ব্যাটিংয়ের জবাবে পাকিস্তান গোটা ইনিংসজুড়ে দাপুটে ও প্রতাপী ব্যাটিংয়ের নমুনা দেখাল। স্কোরবোর্ডে ফকর জামানের ফর্মে ফেরার ৮১ রান এবং ৭ উইকেটের বড় জয় সেই সীলমোহরই দিচ্ছে! পাকিস্তান যখন জয়োল্লাসে ইডেন থেকে ফিরছে তখনো ম্যাচের প্রায় বিশ ওভারই বাকি!
এই হারে বিশ্বকাপ থেকে প্রথম দল হিসেবে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বিদায়। আর পিছলে পড়া পাকিস্তান এই বড় জয়ে আবার বিশ্বকাপের পাহাড়ে উঠার দড়ি খুঁজে পেল!