শুধু সাকিব-তামিমকে নিয়ে না ভেবে সিস্টেম নিয়ে ভাবা উচিৎ বাংলাদেশের
সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বকাপ একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। বিশ্বকাপের এই রোলার কোস্টার রাইডের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। খেলা হিসেবে বললে টেস্ট ক্রিকেট অনেক বেশি উচ্চাঙ্গের ধৈর্যের, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অনেক বেশি উত্তেজক। তবে বিশ্বকাপের সঙ্গে একটা আবেগ মিশে থাকে। আমার মনে আছে, ১৯৯২ বিশ্বকাপ কাভার করার সময় আমাকে তিন জন কিংবদন্তি বলেছিলেন, কি কাভার করতে এসেছেন? এটা কাভার করতে এলেন কেন?
একজনের নাম কিথ প্ল্যেয়ার, একজনের নাম হ্যারল্ড লারো, একজনের নাম বিল্লোরেলি। তারা বলছিলেন এটা কি ক্রিকেট, একদম জঘন্য। ডন ব্র্যাডম্যান এটা জীবনেও খেলতেন না এবং আমার মাধ্যমে শচীনের কাছে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বার্তায় লিখা ছিল, তুমি আমার নাতির বয়সের। দয়া করে এই ক্রিকেট খেলো না। দিস ইজ, লেডি স্পোর্ট। তখন তো মহিলাদের এসব টিম ছিল না, তাই এই কথাগুলো বলেছিলেন।
কিন্তু বিশ্বকাপের সঙ্গে আবেগ মিশে থাকে, এখনও আগের বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান যে পারফম্যান্সটা করেছিলেন, সেটা লোকে ১৫ বছর পরও মনে রাখবে, ২০ বছর পরও মনে রাখবে। এমনকি এই বিশ্বকাপে যে জঘন্য পারফরম্যান্স করেছিলেন, সেটাও লোকে ২০ বছর পরও মনে রাখবে।
লোকে টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে আধুনিক সময়ে এতো একাত্মবোধ করেননি। এমনকি টি-টোয়েন্টি এতো খেলা হয় লোকে ভুলে যায়। কিন্তু বিশ্বকাপ এমন একটা জিনিস, লোকে যা দিয়ে একটা খেলোয়াড়কে ডিফাইন করে। ৮৩ এর টিমে যারা ছিলেন, তাদের চেয়ে আজকের টিমে অনেক ভালো প্লেয়ার রয়েছে। আমি কপিল-গাভাস্কারকে বাদ দিয়ে বলছি। বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় দলে খেলেছেন। ওয়ানডে বিশ্বকাপ একটা মানুষকে লোক গাঁথা রূপ গাঁথা বলতে বাধ্য করে।
জাজ করা যায়, আমি এ কথা বলবো না। আমি বলবো জাজ হয়। মানে এটা আমাদের বিচার বিশ্লেষণের তোয়াক্কা করে না। আমি এখনও মনে করি টেস্ট ক্রিকেট সর্বোচ্চ পরীক্ষা। কিন্তু, মানুষ সে হিসেবে জাজমেন্ট দেয় না। মানুষ মনে করে, সবচেয়ে বেশি দেখা উচিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। মানুষ মনে করে টেস্ট ক্রিকেট উচ্চাঙ্গের কিন্তু, সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় ওয়ানডে ক্রিকেটকে। আর মনে হয় বাংলাদেশ শুধু এবারের বিশ্বকাপে না বরং পিঙ্ক বল টেস্টেও আমি দেখেছি। এখানে শুধু প্লেয়ারদের দোষ দিলে হবে, আসলে ওদের বোর্ড কি করছে?
কারণ, তুমি ইডেন গার্ডেনসে খেলতে এসেছ। এখানে তোমরা দুটি ম্যাচ খেলবে। একটা ম্যাচ থাকবে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে, আরেকটা ম্যাচ থাকবে পাকিস্তানের সঙ্গে। আসলে তুমি কি ইডেন গার্ডেনসের উইকেট সম্পর্কে জানতে? আমরা ইডেন গার্ডেনসে পিংক বল টেস্টে দেখেছি অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মাঠে এসেছিলেন এবং তিনি যেভাবে একটা দলকে উজ্জীবিত করেন। সেটা ফুটবল বিশ্বকাপের অনেক দলের মধ্যে আমরা দেখেছি যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফাইনাল হওয়ার পর মাঠে ঢুকছেন, ঢুকে দলকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। দলকে উজ্জীবিত করতে মাঠে এসেছিলেন তাদের প্রেসিডেন্ট। যখন দেশের কোনও স্পোর্টসে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, আর সেটাকে যদি তারা কাজে না লাগাতে পারেন, আমি বলবো এটা তাদের ব্যর্থতা।
আমি জানতে চাই, ভারতে আজকে এনসিএ যেটা আছে। ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমী। এই বিশ্বকাপেও যখন ইনজুরড বুমরাহ, শ্রেয়াস আইয়ার, লোকেশ রাহুলরা দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন আমরা বলেছিলাম এরা কি করতে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছেন? এরা তো কোনো ম্যাচ খেলেননি। কিন্তু এনসিএর চিকিৎসক এবং ফিজিওথেরাপিস্টরা এদের বিশ্বকাপের আগেই পুরো ফিট করে ফেলেছিলেন। এমনকি এনসিএতে ছয় রকমের পিচ রয়েছে।
বাংলাদেশ এখানে আসার আগে, ইডেন গার্ডেনসে যেমন উইকেট হয়, সেরকম উইকেটের প্রস্তুতি নিয়েছিল কি? নিজেদের স্টেডিয়ামে টার্নিং উইকেট তৈরি করে দিয়ে একে হারিয়ে দিলাম, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিলাম। এর মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। বিশ্ব পর্যায়ের টুর্নামেন্টে খেলার জন্য প্রস্তুতিটা বিশ্ব পর্যায়ের করতে হয়। আমার মনে এই ফ্যাক্টগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অনেকটা উদাসীন।
আজকে ভারতবর্ষ এশিয়ান গেমসে এতো ভালো ফল করছে। ভারতবর্ষে আগে মিল্কা সিং ছিলেন, মিল্কা সিংয়ের মতো দৌড়বিদ ভারতবর্ষ আগে জন্ম দিতে পারেনি। কিন্তু মিল্কা সিং সিস্টেম না থাকা সত্যেও জন্মেছিলেন। এটা একটা এক্সেপশন। কিন্তু এই এশিয়ান গেমসে ভারত অনেক বেশি ভালো ফল করেছে। কারণ ভারতের স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া এখন অনেক বেশি অর্গানাইজড।
এখন এটা বললে, অনেকে আমাকে প্রশ্ন করবেন, আপনি কি বর্তমান সরকারের প্রশংসা করছেন? না, আমি সিস্টেমের প্রশংসা করছি। কারণ তারা এতো মেডেল-জয়ী অ্যাথলেট তুলে দিচ্ছেন। আপনি যদি গোপিচাদের ব্যাডমিন্টন একাডেমীতে যান। আমায় পিভি সিন্দু বলেছিলেন ৪ মিনিট দেরী হলে স্যার জিজ্ঞেস করেন, ভোরবেলায় এতো দেরী হলো কেনো? অলিম্পিকের সিলভার জয়ী পিভি সিন্ধু ভোর ৪ টায় বাড়ি থেকে বের হন, ব্যাডমিন্টন একাডেমীতে পৌঁছানোর জন্য। এরা কিন্তু ইনফ্রাস্টাকচার থেকে হয়েছে।
এখন আমার কথা, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যদি এই ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা যদি তৈরি করতো, তাহলে সাকিবের জন্য এমন আকুলতা তৈর হতো না। আজকে একটা ছেলে যে এতো কিছু করে পার পেয়ে যাচ্ছে, কারণ সে জানে কেউ নেই, আমার ধারেকাছে কেউ নেই। এখন সে যদি জানে, যে আমারও একজন প্রতিদ্বন্দ্বী কাছে আছে, তাহলে বিষয়টা সহজ না।
শারজায় যখন বাসিত আলি জাভেদ মিঁয়াদাদকে বাদ দিয়ে দলে ঢুকেছিলেন, তখন সুনীল গাভাস্কার বলেছিলেন জাভেদ মিঁয়াদাদের মনে রাখা উচিত ছিল, যে ঘরোয়া ক্রিকেটে ইদানীং জাভেদ মিঁয়ায়াদাদ কেমন রান করছে। ও আত্মতুষ্ট হয়ে বসেছিল। সাকিবেরও তাই মনে হতো। দলটারও ভালো হতো। আমি সাকিব-তামিমের ঝগড়ার মধ্যেই যাচ্ছি না। তিনটি নতুন ছেলে যদি আসতো তাহলে এই ঝগড়াটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত। মানে, তোরা ঝগড়া কর, আমি তিনটি নতুন ছেলেকে টিমে ঢুকিয়ে নিলাম।
ভারতবর্ষে স্পটিংটা কিন্তু নিখুঁত। আমার মনে আছে জাসপ্রিত বুমরাহকে কোনো ভারতীয় কোচ স্পট করেননি, তাঁকে স্পট করেছিলেন জন রাইট। আমার প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এই স্পটাররা কি এখনও আছেন, যারা গ্রামে গঞ্জে গিয়ে নতুন প্রতিভা তুলে আনেন। আমার মনে হয় বাংলাদেশে শুধু একজন সাকিব কিংবা তামিমকে নিয়ে না ভেবে সিস্টেমটা নিয়ে ভাবা উচিৎ।
গৌতম ভট্টাচার্য-ভারতীয় সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক