রাজনীতির আগুনে চিতায় ক্রিকেট!
পাকিস্তানে ‘এ’ দল নিয়ে সফরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, রাজনীতির প্রভাব ক্রিকেটে পড়ে না। ক্রিকেট ক্রিকেটের গতিতে এগিয়ে যায়।
নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক যা বলেছেন তা তিনি বিশ্বাস করেন কি না, প্রশ্নটা উঠতেই পারে! রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে যদি নিমোর্হ দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন তাহলে আব্দুর রাজ্জাকের এই মন্তব্যকে আপনার কাছে মনে হতে পারে তিনি দুধের বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন!
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সহ গোটা দেশের ক্রীড়াঙ্গন যে অস্থিতিশীল, বেহাল এবং অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে সেটা পরিস্কার।
ঐতিহ্যবাহী আবাহনী লিমিটেড ক্লাব ভাঙচুর হয়েছে। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে মূল্যবান স্মৃতি-অর্জন। ক্লাবের ৫০ বছরের ইতিহাসের সব ট্রফি, শিল্ড লুট হয়ে গেছে। গোটা ক্লাব শশ্মানে পরিণত! রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন ছারখার করে দিয়েছে পুরো ক্লাবের চত্বর, কাঠামো। ভাঙ্গা দেয়াল, টুকরো চেয়ার আর পোড়া অবয়ব নিয়ে দাঁড়ানো ক্লাবের ভৌতিক পরিবেশ যেন চিতাভস্ম!
মাশরাফির নড়াইলের বাড়ি পুড়েছে রাজনীতির আগুনে। যশোরে সাকিবের রাজনৈতিক কার্যালয় ছাই সেই অনলে। তারা দুজনেই আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। কিন্তু সেই রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়েও তো তারা ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার। ক্রিকেট আইকন। অধিনায়ক। আমাদের অনেক জয় আনন্দের নায়ক।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন কোথায় আছেন, কেমন আছেন-তার কোনো হদিস নেই। নিরাপত্তার আশঙ্কায় বোর্ড পরিচালকরা কেউ বিসিবিতে আসছেন না। স্পোর্টস বাংলার কাছে বিসিবি’র কয়েকজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিসিবিতে তারা আর ফিরছেন না। তাদের সময় শেষ। বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন তারা।
বিসিবির বর্তমান কমিটির সিংহভাগ পরিচালক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বয়ং বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী। বর্তমানে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের এই সময়ে তাদের প্রায় সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে। এদের অনেকেই দেশে আছেন নাকি বিদেশে- তাও অজানা।
বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজনের উচিত ছিল পুরো পরিস্থিতি নিয়ে মিডিয়াকে ব্রিফ করা। কিন্তু তিনিও আড়ালে। বোর্ডে আসছেন কেবল অধস্তন কয়েকজন কর্মচারী। বিসিবির চেয়ারে বসে পড়ার খায়েশ নিয়ে স্টেডিয়াম চত্বরে এরই মধ্যে জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে মিছিল এবং শোডাউনও সেরেছেন কিছু চেনা-অচেনা এবং পল্টিবাজ সংগঠকের দল।
সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এতোই নাজুক ছিল যে ক্রিকেটারদের অনুশীলনও স্থগিত করা হয়। তবে স্বস্তির বিষয় হলো এর মধ্যেও ‘এ’ দল শুক্রবার (৯ আগস্ট) পাকিস্তান সফরে রওয়ানা হয়েছে। তবে বিসিবির পরিচালকদের কেউ বোর্ডে না আসায় এবং তাদের লুকিয়ে থাকা ও পলায়নপর মানসিকতায় পুরো ক্রিকেট বোর্ডের চেহারা এখন পাওয়ার প্লেতে ১৫ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলা ক্রিকেট দলের মতোই ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য! প্রাণ আছে কিন্তু জড়বস্তু!
বিসিবির এই আড়ালে চলে যাওয়া পরিচালকরা যদি সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন যে তারা আর বোর্ডে ফিরবেন না তাহলে সেটা প্রধান নির্বাহীকে জানিয়ে দিলেই তো পারেন। যেমনটি করেছেন বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদী। চিঠি আকারে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে যারা এমন অস্থির পরিস্থিতিতেও বোর্ডে থাকতে চান তারাও তাদের মতামত জানিয়ে দিলে সঙ্কট সমাধান দ্রুত হবে। সিদ্ধান্তহীনতা মানেই ডালে ঝুলে থাকা। আর সেই ডাল কাটার জন্য নিচে দাড়িয়ে কিছু লোক দা-বটিতে শান দিচ্ছে- কসাইয়ের দোকানের এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই ক্রিকেটের বারান্দার জন্য শোভনীয় কিছু নয়!
রাজনীতি; চার অক্ষরের এই শব্দের প্রতিশব্দ তাহলে ঘৃণা, আগুন, ধংস আর হত্যার বুনো উল্লাস! কাকে দোষ দিবো? মানুষকে? এই মানুষ এবং অমানুষই তো আমি-আপনি। এই রূপ আপনার আমার অনেক দিনের চেনা জানা। দরজা ঠেলে বের হলেই এরাই তো পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। একই দেশ, একই শহর, একই মহল্লা গলিতে বাস; অথচ রাজনীতি ও ক্ষমতার স্বার্থে মুহূর্তেই প্রতিবেশি রূপ বদলে একহাতে তলোয়ার আর অন্য হাতে আগুন নিয়ে রক্তপিপাসু জল্লাদ!
তবুও কি আশ্চর্য এই রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। কখনো জানাজার নামাজের সারিতে দাড়াতে হয়। আবার কখনো হাততালি দিতে হয়!