হারের পর যা বললেন মিরাজ
প্রথম টেস্টে হেরে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। এই ম্যাচে বাংলাদেশের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বেশ, বিশেষ করে এক পেসার খেলানোর কৌশল নিয়ে। এ ম্যাচে প্রাপ্তি হিসেবে আছে মেহেদি হাসান মিরাজ, জাকের আলীর, আর বোলিংয়ে তাইজুল ইসলামের লড়াই।
ম্যাচ শেষে এ সব তো বটেই, সঙ্গে সাকিব আল হাসানের না থাকা, দলের পরিবেশ, ও বিশেষ করে ব্যাটারদের ব্যর্থতা নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করেছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। স্পোর্টস বাংলার পাঠকদের জন্য তার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো–
তিন রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস, আফসোস হচ্ছে কি না?
সেঞ্চুরি মিস হয়ে গেলে একটা ব্যাটারের খারাপ লাগে, অবশ্যই খারাপ লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সেঞ্চুরি করার চেয়ে যে প্ল্যান নিয়ে খেলছিলাম, সেটা এক্সিকিউট করতে পারলে ভালো লাগত। সেঞ্চুরি নিয়ে চিন্তা করিনি। চিন্তা করছিলাম দলকে কোন অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়।
ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণ কী?
ডিসিশন মেকিংটা গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো আমাদের কিছু জায়গায় অভাব আছে, এ কারণে হয়তো ব্যাটিংয়ে ফল্ট করছি। কিন্তু আমার কাছে যা মনে হয় যে, উপরের দিকে জুটি গুরুত্বপূর্ণ, টপ অর্ডার থেকে ভালো শুরু পাওয়া যেতে পারত, তাহলে পরের ব্যাটারদের জন্য সহজ হতো। পাকিস্তানে প্রথম টেস্টে টপ অর্ডার, মানে তিন চার নম্বর থেকে শুরু করে ভালো একটা স্টার্ট দিয়েছিল। ওপেনাররাও একটা ভালো শুরু দিয়েছে, তারাও ভালো খেলেছে। পরে যারা ছিল তাদের কাজটা সহজ হয়ে যায়। টেস্ট ক্রিকেটে আপনি দেখেন যে পাঁচ ছয়ের ব্যাটার যদি নতুন বল খেলতে হয়, তাহলে একটু কঠিন হয়ে যায়। অবশ্যই সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। যে টপ অর্ডাররা কীভাবে সফল হতে পারে, বেশিরভাগ টেস্ট ক্রিকেটে যেন সফল হতে পারি, সেজন্য আমরা কথা বলছি। আশা করছি সামনে যে টেস্টগুলো আছে, আমরা বুঝতে পারব যে আমাদের কোন জায়গায় অভাবগুলো আছে।
আপনি ব্যাট করেছেন, আপনার সতীর্থরাও করেছে এখানেই। আপনার কাছে উইকেট কঠিন মনে হয়েছে কি না?
আপনি দেখেন যে, উইকেটটা হ্যাঁ, আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম, আমাদের দিকেই ছিল সব কিছু ছিল। আমরা টস জিতে ব্যাট করেছি। আমরা চেয়েছিলাম ব্যাট করতে। কারণ মিরপুরে চতুর্থ দিনে ব্যাট করাটা কঠিন। আমরা ওভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা রান করতে পারিনি। দ্বিতীয় ইনিংসের রানটা প্রথম ইনিংসে হলে খেলা অন্যরকম হত। প্রথম ইনিংসেই ব্যাকফুটে চলে গিয়েছি। দুই সেশনের আগে, ১০৬ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছি। টেস্ট ক্রিকেটে অবশ্যই প্রথম ইনিংসের রানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান সিরিজে আপনারা যে খেলা খেলেছেন, ভারত সিরিজে হয়তো একটু খারাপ খেলেছেন। এই সিরিজে প্রত্যাশা ছিল যে দল একটা ভালো পারফর্ম্যান্স দেবে। আমাদের কোন জায়গাটা খুবই দুর্বল? শুধু কি ব্যাটিং ব্যর্থতা? নাকি প্ল্যানিং, এক্সিকিউশন ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না?
ভালো ক্রিকেট খেললে এত প্রশ্ন আসত না, আমাদের ব্যর্থতা। আমরা দল হিসেবে খেলতে পারিনি। এক দুই জন ভালো করলে দলীয় ফলাফল পাওয়া যায় না। কাজটা আমরা পাকিস্তান সিরিজে করে এসেছিলাম। পাকিস্তানে আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি। হয়তো আমাদের কিছু কিছু জায়গায় অভাব ছিল। তারপরও আমরা জিতেছি। কিন্তু আপনি যেটা বললেন যে, আমাদের অনেক উন্নতি করার জায়গা আছে। ব্যাটারদের আরও বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটে আমরা বোর্ডে রান না দিতে পারলে বোলারদের কাজটা কঠিন হয়ে যায়। আমাদের বোলাররা খুবই ভালো বল করেছে। যেভাবে প্রেসার নিয়ে সবসময় বোলিং করেছে, সেটার অবশ্যই ক্রেডিট দিতে হবে। তাইজুল ভাই খুব ভালো বোলিং করেছে। তো আমরা ওই ডিসকাসটাই করছি। প্রত্যেকটা ব্যাটার রান করবে না। কিন্তু অন্তত ৩-৪টা ব্যাটার রান করে, সেটা যেন বড় রান হয়, তো সে চেষ্টা করছি, ব্যাটাররা মিটিং করছি। আশা করছি সামনের টেস্টগুলোয় কামব্যাক করতে পারব।
ওপরের দিকে ব্যাটিং করার আগ্রহ আছে কি না?
আপনি যেটা বললেন যে ওপরের দিকে ব্যাট করতে পারি কি না, এটা আসলে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। যারা দল নির্বাচন করবে, তারা দলের ভালোর কন্য সিদ্ধান্ত নেবে।
সাকিবের বিদায়ী টেস্ট হতে পারত, সাকিব আল হাসানকে আপনি কতটা মিস করেছেন?
সাকিব ভাই ইস্যুটা আমরা সবাই জানি। সে কীসের জন্য আসেনি, খেলতে পারেনি, এটা আমার মনে হয় না যে কারো অজানা। অবশ্যই সে লিজেন্ড, সে বাংলাদেশের জন্য অনেক অর্জন করেছে। এই পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।
টপ অর্ডারদের সমস্যা কী? আপনি কী ঠিক করছেন?
আমরা সুযোগ পাচ্ছি। আমার ভালো লাগছে সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পেরে। আমি যেখানে ব্যাট করি, সেটা আমার জন্য কঠিন। আমি এখান থেকে ভালো খেললে দল ভালো জায়গায় যাবে, খারাপ খেললে দল ভালো ফলাফল পাবে না। কিন্তু মানসিকভাবে আমি নিজে ভালো খেলার চেষ্টা করছি। আলহামদুলিল্লাহ রান করছি। আমি রান করলে দল উপকার পায়, সেটা খেয়াল করেছি। আমার ব্যাটিংটা উন্নত করার চেষ্টা করছি দিনকেদিন। ক্যারিয়ারের শুরুতে আমার গড় ছিল ১.৫। সেখান থেকে দিনকেদিন ভালো করার চেষ্টা করছি, সেভাবে আমি কাজ করছি ব্যাটিং নিয়ে।
পাকিস্তান-ভারতে প্রত্যাশা ছিল না তেমন। এই সিরিজ শুরুর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার অনভিজ্ঞতা, মিরপুরের চেনা জানা উইকেট নিয়ে জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন শান্ত। ওখান থেকে আপনারা কতটা হতাশ?
ঘরের মাঠে প্রত্যাশা সবারই থাকে। আমাদের থাকে, সবারই থাকে। আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারিনি, সেটা স্বীকার করছি। যেহেতু মিরপুরে আমরা সবচেয়ে ভালো জানি, আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারিনি। এটার দায় আমরাই নিব। যেহেতু আমরা ম্যাচটা হেরে গেছি, এখনও একটা ম্যাচ বাকি, জিততে পারলে ভালোভাবে কামব্যাক করতে পারব।
আপনি বলেছিলেন দল টি-টোয়েন্টি খেলছিল গত মে-জুলাইয়ে, তখন আপনি ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন বলেছিলেন। অন্য যারা টেস্ট ক্রিকেটার তারাও তো কাজ করে। যেমন তারা নতুন বলে খেলে, আপনারও মাঝে মধ্যে নতুন বলে খেলতে হয়। এ বিষয়ে কোনো কথা শেয়ার করা হয় কি না?
৮০ ওভারের পরে ব্যাট করতে হয় নতুন বলে। সেটা নিয়ে কাজ করছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সারভাইভ করা, রান করা, একটা বোলারকে কীভাবে ডমিনেট করতে পারি, সেটা নিয়ে কাজ করছি। দলে যারা অভিজ্ঞ আছে, তাদের সঙ্গে শেয়ার করছি, তারাও আমার সঙ্গে শেয়ার করছে।
ম্যাচে পরিকল্পনা কী ছিল? আমরা একটা পেসার নিয়ে খেলেছি, এখানে দক্ষিণ আফ্রিকান পেসাররা ১৩ উইকেট নিয়েছে, আমাদের হাসান মাহমুদও ভালো বল করেছে? এক পেসার নিয়ে খেলাটা টেকনিকাল ব্লান্ডার কি না?
আমরা যেমন এক্সপেক্ট করেছিলাম মিরপুরের উইকেটে টার্ন হবে, আমরা স্পিনাররা ডমিনেট করব। এর আগেও কিন্তু আমরা এক পেসার নিয়ে খেলেছি। সে প্রত্যাশা অনুযায়ী করতে পারিনি। বোলার তো চারটা ছিল, এক পেসার, তিনটা স্পিনার। এখানে মিরপুরে স্পিনাররা ডমিনেট করে, কিন্তু কন্ডিশনটা অন্যরকম হয়ে গেছিল। ওরাও ভালো বল করেছে, আমাদের হাসান মাহমুদও ভালো বল করেছে। আমরা স্পিনাররা ভালো করলে, আমি আর নাইম ভালো বল করলে এই প্রশ্ন আসত না। বিশেষ করে আমি, আমার কাছে দল চায় ৫-৬ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জেতাব, সেটা করতে পারিনি। ওখান থেকে ব্যাকফুটে পড়ে গিয়েছি।
টেস্টের শুরুতে শান্ত বলেছিলেন, সাকিবের শূন্যস্থানে ব্যাটিংয়ে আপনাকে দিয়ে পূরণ করার? আপনার কি মনে হয় আপনি তা পূরণ করতে পেরেছেন?
আপনারা সবসময় বলেন সাকিব ভাইয়ের জায়গায় আমি আসব। সাকিব ভাই কিন্তু অনেক বড় অ্যাচিভমেন্ট করেছে বাংলাদেশ দলের জন্য। ১৭ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে। সে একজন লিজেন্ড। আমি রান করা শুরু করেছি ২-১ বছর। সাকিব ভাই শুরু থেকে রান করেছে। সাকিব সাকিবের জায়গায় আমি আমার জায়গায়। একটা খেলোয়াড়ের সঙ্গে আরেক খেলোয়াড়ের তুলনা না করাটাই বেস্ট আমার মনে হয়। আমরা জানি সাকিব ভাইয়ের অর্জন কত। আমি যেখানে ব্যাট করি ৭-৮ নম্বরে। সাকিব ভাই ওপরে খেলেছে। এটা কঠিন, তবে আমার যখন সুযোগ এলে চেষ্টা করব দলের প্রয়োজনে ভালো ক্রিকেট খেলার।
ব্যাটাররা আপনার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছে?
আমাদের সব সময় কথা হয়। যখন দুইটা ব্যাটার ব্যাটিং করে, তখন তারা মাঝের বিষয়টা সবচেয়ে ভালো বুঝে, কন্ডিশন কেমন হচ্ছে, তারা তথ্য দিতে থাকে ব্যাটারদের।
আপনার কি একটু কঠিন পরিস্থিতি এলেই ভালো হয় কি না, মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন কি না? ওটার জন্য নিজেকে কিভাবে তৈরি করেন?
আমি সব সময় কঠিন পরিস্থিতি উপভোগ করার চেষ্টা করি। বেশি কিছু চিন্তা করি না। চিন্তা করার চেষ্টা করি, আমার জন্য এটা সুযোগ। ভালো করলে তো হিরো হওয়ার সুযোগ থাকে।
এই সিরিজের আগে কোচ ছিলেন হাথুরু, এই সিরিজে সিমন্স। নতুন কোচ কী কাজ করেছেন?
তিনি এসেছেন দুই দিন হয়। একটা মানুষ সম্পর্কে তো আপনি তিন দিনে কিছু বলতে পারেন না। মাত্র শুরু করেছেন, যোগাযোগ করছেন। ভালো দল গড়ার চেষ্টা করছেন। দলের বন্ধনটা তৈরি করার চেষ্টা করছেন। সে চেষ্টা করছেন তিনি।
মিরপুর টেস্টে তার পরিকল্পনা কী ছিল?
প্রথম এসেছেন, তার অভিজ্ঞতা ছিল না। দলের খেলোয়াড় ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
ভালো করলে হিরো হওয়ার চান্স থাকে, ওটা তো ওপরের ব্যাটারদের জন্যও প্রযোজ্য। বিষয়টা এমন না যে একটা সিরিজে এমন হচ্ছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ৯ ম্যাচ পর ৭-৮-৯ এ খেলা ব্যাটার যখন সর্বোচ্চ রান করেন, তখন পরিস্থিতিটা বুঝা যায়। ব্যাটিংটা ভাবনার বিষয়, কিন্তু এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ওপর থেকে যদি রান করা যেত, আমাদের দলের জন্য ভালো হতো। আমি সাপোর্ট দিলে ভালো ফল করা যেত। আমাদের ব্যাটাররা যতটুকু করেছে, তার চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি দিলেই আর ভালো করা যেত। যেমন ধরেন, টপ অর্ডারে এক জন ক্লিক করেছে, আরেকজন ক্লিক করলে ভালো হতো। আমাদের ব্যাটাররা ইনিংস খেলেছে, বড় হয়নি। ৫০-৬০ ১০০ আর ৩০ টা ৭০ হলে বড় রান হতো। পাকিস্তানে যে ইনিংসটা ৫০০ হয়েছিল, সাদমান ভালো করেছিলেন, মুমিনুল ভাই, মুশফিক ভাই, লিটনরাও করেছিলেন... তখন আমার ৭৭ এ গিয়ে রানটা ৫০০+ হয়ে গিয়েছে। এখানে ডিফারেন্সটা হলো টপ অর্ডাররা যদি ভালো রান করে তাহ;লে আমাদের কাজ সহজ হয়ে যায়।
আবার হয়তো টপ অর্ডাররা ভালো করলে আমার সুযোগ কমে যেত! আমি বেশি করতে পারতাম না!
দলের পরিবেশ এখন কেমন দেখছেন?
হারলে খারাপ লাগে, জিতলে ভালো লাগে। ভেঙে পড়লে চলবে না। চট্টগ্রাম টেস্টের প্ল্যান করতে হবে। দেখব কীভাবে ল্যাকিংস ওভারকাম করা যায়।