১২ বছর পর বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারত
ম্যাচের ফলটা তো ওই প্রথম ইনিংস শেষেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তো বটেই, নকআউট পর্বও কখনো এত রান দেখেনি। সে রান তাড়া করে নিউজিল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা কমই ছিল। কিউইরা শেষমেশ তা করতে পারেওনি।
ওয়াংখেড়েতে আজ তারার হাট বসে গিয়েছিল। এখানকার ঘরের ছেলে শচীন টেন্ডুলকার, ফুটবল কিংবদন্তি ডেভিড বেকহ্যাম থেকে শুরু করে বলিউড তারকা আনুষ্কা শর্মা, রণবীর কাপুর, কিয়ারা আদভানি, সিদ্ধার্থ মালহোত্রা, জন অ্যাব্রাহ্যাম… কে ছিলেন না! সেখানে ভারত হেরে বসলে পরিস্থিতিটা খানিকটা বিদঘুটেই ঠেকত। সেটা শেষমেশ মোহাম্মদ শামিরা হতে দেননি। ৩৯৭ রান ডিফেন্ড করেছেন অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যেই। ভারত মাঠ ছেড়েছে মুখে হাসি আর ঝুলিতে ৭০ রানের জয় নিয়ে। তাতে ১২ বছর পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনালে চলে গেছে রোহিত শর্মার দল।
আজ টস ভাগ্যটাও সঙ্গ দিয়েছে ভারতেরই। ওয়াংখেড়েতে টস জিতলে যে কোনো অধিনায়কই ব্যাটিং নিতে চাইবেন, রোহিতও তাই করেছেন। এরপরের গল্পটা ভারতের ‘মোন্টাজ’এর।
চলতি বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার ভূমিকাটা অনেকটা ছোট গল্পের মতো, ‘অন্তরে অতৃপ্তি’ রবে ঠিক, কিন্তু এর ছাপটা হবে বড়। আজও হলো তাই। চারটা ছক্কায় সাজালেন ২৯ বলে ৪৭ রানের ইনিংস, সেটা ভারতকে এনে দিল উড়ন্ত সূচনা। ভারতের রকেট ছুটল।
এর পরের মঞ্চটা বিরাট কোহলির। বিশ্বকাপের নকআউট এলেই যেন কী হয়ে যায় তার, ৬ ইনিংসে ৭৩ রান, গড় ১২.১৬। আজ হলো না। সেই বিদঘুটে ইতিহাসটাকে কোহলি আজ জাদুঘরে পাঠালেন। খেললেন ১১৩ বলে ১১৭ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। গড়লেন একগাদা রেকর্ড। শচীনের এক বিশ্বকাপে ৬৭৩ রানের রেকর্ড, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের রেকর্ড, ৪৯ সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড।
তাকে সঙ্গ দিলেন শ্রেয়াস আইয়ার। সেঞ্চুরি করলেন কোহলির চেয়েও দ্রুতগতিতে। শেষে এসে লোকেশ রাহুলও রান তুললেন ২০০ ছুঁইছুঁই স্ট্রাইক রেটে। সব কিছুর মিশেলে ভারত ইনিংস শেষ করে ৩৯৭ রান তুলে। বিশ্বকাপ নকআউটে এর চেয়ে বেশি রান তুলতে পারেনি আর কোনো দল।
নিউজিল্যান্ডের ফাইনালের রাস্তায় এভারেস্ট তুলে দেওয়ার কাজটা সেরেই ইনিংস শেষ করেছিল ভারত। ৭০ বছর আগে আক্ষরিক অর্থেই কাজটা করেছিলেন নিউজিল্যান্ডেরই শেরপা স্যার এডমুন্ড পারসিভাল হিলারি, মানবজাতির ইতিহাসে এভারেস্ট জয় করেছিলেন প্রথমবারের মতো। এ প্রসঙ্গটা সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেও উঠে এসেছিল। হিলারির মতো কাজটা ম্যাচে করে দেখানোর দায় পড়বে কিউইদের, সেটা কে ভেবেছিল?
বড় লক্ষ্য সামনে পেলে বেশিরভাগ দলেরই যা হয়, নিউজিল্যান্ডেরও হলো; ভড়কে গেল যেন খানিকটা। পাওয়ার প্লেতেই সাজঘরমুখো হলেন দুই ওপেনার রাচীন রবীন্দ্র আর ডেভন কনওয়ে। শুরুর দশ ওভারে নিউজিল্যান্ড তুলতে পারল মোটে ৪৬ রান।
নিউজিল্যান্ডের কামব্যাকের শুরু সেখান থেকেই। পরের দশ ওভারে কেন উইলিয়ামসন আর ড্যারিল মিচেল মিলে তুললেন ৭৮, তার পরের দশ ওভারে ৭৫। একটু একটু করে কিউইরা ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রান তোলা শুরু করেছিল। শেষ ২০ ওভারে দরকার ছিল ১৯৯ রান, হাতে ছিল ৮ উইকেট।
ব্ল্যাকক্যাপদের পথ হারানোর গল্পটা শুরু এরপর থেকে। জুটিতে রান তোলার দায়িত্বটা ছিল মিচেলের ওপর, উইলিয়ামসন সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন স্রেফ। বাড়ন্ত আস্কিং রেটের চাপটাকে আরব সাগরে ছুঁড়ে ফেলতেই হয়তো, নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের মাথায় চেপে বসল ছক্কার নেশা। সেই নেশাই তার ইনিংসের অপমৃত্যু ডেকে আনল। সঙ্গে সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের আশারও। তাকে ফেরালেন মোহাম্মদ শামি, যিনি ওভার দুয়েক আগে তার ক্যাচ ছেড়ে ভিলেন বনে যাওয়ার রাস্তা তৈরিই করে রেখেছিলেন। সেই শামি পরের বলে টম ল্যাথামকেও ফেরালেন। মুহূর্তে ম্যাচটা চলে আসে ভারতের কবজায়।
গ্লেন ফিলিপসকে সঙ্গে নিয়ে মিচেল তাও পরিস্থিতিটা অনুকূলে আনার চেষ্টা করছিলেন। শেষ দশ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৩২ রান, হাতে ছিল ৬ উইকেট। নিউজিল্যান্ড হেরে বসল এখানেই। রানের চাপ মাথায় না রেখে শেষ দশ ওভারে রান তোলা সহজ, কিন্তু আস্কিং রেট মাথার ওপর ঝুলতে থাকলে তা যে বেশ কঠিন, তারই প্রমাণ মিলল।
ফিলিপস ফিরলেন প্রথমে, এরপর সেঞ্চুরি করে নিউজিল্যান্ডের আশার বাতিঘর হয়ে থাকা মিচেলও সাজঘরমুখো হলেন। নিউজিল্যান্ডের হারটা তখন সময়েরই ব্যাপার ছিল। শুরুর পাঁচ ব্যাটারকে ফিরিয়ে মূল কাজটা সেরে দিয়েছিলেন শামি। বাকিটা সারলেন বুমরাহ, কুলদীপ, জাদেজারা; শামি নিজেও নিলেন আরও দুটো উইকেট। ভারতকে এনে দিলেন দারুণ এক জয়। খলনায়ক বনে যাওয়ার মুখ থেকে নিজে হলেন এক যুগ পর ভারতকে ফাইনালে তোলার অন্যতম নায়ক।