মোনেম মুন্না: চিরবিদায়ের ২০ বছর, কতোটা মনে রেখেছি কিংবদন্তিকে?
ধানমন্ডির শেরেবাংলা রোডের ৪৯/এ নম্বর বাড়ির ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে সূর্যের আলো ঢুকছে জানালা বেয়ে। একটা ফ্রেমে বন্দি এক তরুণের হাসিমাখা মুখ। পাশে সারিবদ্ধ কিছু ট্রফি, সম্মাননা স্মারক। সেই ট্রফির ধুলোমাখা গায়ে হাত বুলিয়ে দেন সুরভী মোনেম। সময় যেন থমকে গেছে, শুধু স্মৃতিগুলো বেঁচে আছে।
আজ ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। ঠিক কুড়ি বছর হয়ে গেল। ২০০৫ সালের এই দিনেই চিরতরে চলে গিয়েছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি মোনেম মুন্না। অথচ তার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতি ফাহাদ করিম অবশ্য বলেছেন, তারা ভবিষ্যতে কিংবদন্তিদের স্মৃতি সংরক্ষণে আর্কাইভ করার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু আজকের দিনে এসে এসব প্রতিশ্রুতি সুরভীর কানে যেন বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়!
সুরভীর চোখ চলে যায় একটা পুরনো ছবির দিকে। সেটা তাদের পরিচয়ের প্রথম দিনগুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। ল্যান্ডফোনের দিনগুলো ছিল তখন। একদিন হুট করেই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। ওপাশে এক তরুণী বললেন, ‘আপনি কি মুন্না বলছেন? কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে?’ সেই কথোপকথনের পর এক অনন্য পথচলার শুরু। কিছুদিন লুকিয়ে কথা বলা, তারপর দুই পরিবারের সম্মতি। মাস ছয়েকের পরিচয়ের পর ১২ ফেব্রুয়ারি তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। অথচ বিয়ের সেই তারিখই হয়ে গেল শোকের প্রতীক।
১৯৯৫ সালে মুন্নার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় করে। তার পায়ের জাদুতে মোহিত হয়েছিল কলকাতার ইস্ট বেঙ্গলও। কিন্তু দেশের মানুষ যেন তাকে ভুলতেই বসেছে। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় নানা মানসিক কষ্ট তাকে পেয়ে বসে। এরপর অসুস্থতা, দুটি কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়া, বড় বোনের কিডনি দান, চিকিৎসা, সাময়িক সুস্থ হয়ে ফেরা-সবকিছুই যেন একটা কঠিন লড়াইয়ের গল্প। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।
মুন্নার মৃত্যুর পর একা হাতে সন্তানদের বড় করেছেন সুরভী। আজমান সালিদ একটি এডুকেশনাল কনসালটেশন ফার্মে কাজ করছে, আর মেয়ে ইউসরা নরওয়েতে মাস্টার্স করছে। সুরভী জানেন, তার সন্তানরা বাবার আদর্শে গড়ে উঠেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তিনি ভাবেন, ‘আজ যদি মুন্না থাকত, তবে আরও ভালোভাবে পথ দেখাতে পারত ওদের।’
বইয়ের তাকে রাখা একটা পুরনো অ্যালবাম টেনে নেন সুরভী। পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থেমে যান। মুন্নার ফুটবল মাঠের ছবি। তার চোখের কোণে জল জমে ওঠে। আজ যদি তিনি আবার ফিরে আসতেন! সন্তানরা বড় হয়ে গেছে, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। একলা দুপুরগুলো যেন আরও নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে।
স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে তিনি ভাবেন, মুন্নার জায়গা শুধু স্মৃতির পাতায় নয়, দেশের ফুটবলের ইতিহাসেও উজ্জ্বল হয়ে থাকা উচিত। তাঁর জন্য একটা জাদুঘর হতে পারত, একটা ট্রফি তার নামে হতে পারত। হয়তো একদিন হবে, হয়তো নতুন প্রজন্ম তাকে আবার মনে করবে।
সুরভী জানেন, মুন্না শুধু তার স্বামী ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আজ হয়তো তিনি দূরে, কিন্তু তার স্মৃতি, তার ভালোবাসা, তার আদর্শ-এগুলো কখনো হারিয়ে যাবে না।