স্বর্গারোহনের এক বছর
গোল্ডেন বলটা নিতে উঠে আসছেন ডায়াসে। পাশে রাখা বিশ্বকাপ, সোনার হরিণটা। অশ্রুসজল চোখে ট্রফিটার দিকে একপাক তাকালেন। মুহূর্তে জ্বলে উঠল একগাদা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। গ্রহের সেরা খেলোয়াড়, অথচ শিরোপাটা ছোঁয়ার কোনো অধিকার তার নেই! এমন মুহূর্ত তো বাজারে বিকোয় বেশ ভালো, ট্র্যাজিক হিরোর কদর তো মানুষের কাছে নেহায়েত কম নয়! আলোকচিত্রীদের এ ভাবনাকে খুব একটা শাপশাপান্ত করা যায় না, এমন আইকনিক মুহূর্ত কে হেলায় হারাতে চায় বলুন?
এস্তাদিও দে মারাকানা ব্রাজিলের জন্য এক আফসোসের নাম। ওই দৃশ্যটার আগে পরে সে মারাকানা বনে গেল শত্রু ডেরার, তাদের সর্বাধিনায়কের জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোসের নামও। সে দৃশ্যটা বনে গেল লিওনেল মেসির জীবনের সবচাইতে আইকনিক মুহূর্তও।
এরপর মেসির জীবনে কত পরিবর্তন এলো! মোটাদাগে তার ক্যারিয়ারের গ্রাফটা নিম্নমুখী ছিল, তার নিজের মানদণ্ডে অন্তত। সে গ্রাফটা থামল এসে ২০২১ এ। অন্তত একটা ট্রফি জেতাতে চেয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে, সেটা পেলেন। কিন্তু যে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপের পিপাসা, তাদের কি আর কোপা দিয়ে তুষ্ট করা যায়? তিনি নিজেও কি তুষ্ট হতেন? হতেন না!
একটা বিশ্বকাপের আফসোস রয়েই গিয়েছিল। এই একটা শিরোপার খুব কাছ থেকেই তো হেঁটে গিয়েছিলেন ওই ‘প্রথম’ বার! সে আফসোসটা ঘোচানোর শুরুটা হলো বেশ বাজে, পুঁচকে সৌদি আরবের কাছে হার, তাও আবার এক গোলে এগিয়ে গিয়ে!
সেখান থেকে উদ্ধার করলেন দলকে। এরপর একে একে সব বাঁধা পেরিয়ে এল ১৮ ডিসেম্বর রাত। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের সে ফাইনাল। সে ফাইনালে গোল করলেন পেনাল্টি থেকে, এরপর আনহেল দি মারিয়া করলেন আরও একটা। দুয়ের যোগফলে এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল আর্জেন্টিনাকে এবার আটকায় কে!
আটকে ফেললেন, কিলিয়ান এমবাপে নামের একজন। সাড়ে চার বছর আগে ‘অপয়া’ কাজানে এই এমবাপের জোড়া গোলে বিদায় নিতে হয়েছিল মেসিকে, এবারও সেই এমবাপে, এবারও সেই জোড়া গোলই করলেন, জয় থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে থাকা আর্জেন্টিনার পথ আটকে বাধ্য করালেন অতিরিক্ত সময় খেলতে।
সেখানেও মেসি করলেন এক গোল। জয় থেকে আকাশী-সাদারা যখন তিন মিনিটের দূরত্বে, তখন আবারও গোল এমবাপের। স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচটা গড়াল পেনাল্টি শ্যুটআউটে। সেখানে আর কোনো নাটক নয়। আর্জেন্টিনা জিতল অবশেষে।
একটা নয়, দুটো নয়, কাতারের আগে মেসির বিশ্বকাপ খেলা হয়েছে আরও চারটা। এক একটা বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে, আর মেসির বিবশ মুখখানা দেখে প্রত্যেকবারই মনে তিনি বুঝি আটকে গেছেন ইনফার্নোতে, দান্তের বিবৃত ইনফার্নো, যেখান থেকে কোনো নিস্তার নেই, কোনো নিদান নেই…
সে ধারণাটাকে ভুল প্রমাণ করল লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম, দোহা, কাতার, ১৮ ডিসেম্বর। ২০১৪ এর ১৪ জুলাই রিও ডি জেনিরোতে যে দুঃখটা পেয়েছিলেন, যে জগদ্দল পাথরের বোঝাটা সওয়ার হয়েছিল কাঁধে, সেটা নেমে গেল দোহায়।
এবারও গোল্ডেন বলটা পেলেন। মারাকানায় পুরস্কারটা নিতে যাবার সময় হাপুস নয়নে দেখছিলেন চেয়ে। এবার সে আক্ষেপটা ঘোচালেন। ট্রফিটা নিয়ে নামার পথে কি ভেবে দাঁড়ালেন, চুমু খেলেন পরম আরাধ্য বিশ্বকাপে। সিনেমায় দেখা এত্তো এতো ‘রিডেম্পশন আর্ক’কে পেছনে ফেলা এক ‘রিডেম্পশন আর্কে’র দেখা মিলল বাস্তবে।
এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন শিরোপাটা আনুষ্ঠানিকভাবে উঠে গেল হাতে। ধারাভাষ্যে থাকা থাকা পিটার ড্রুরি আবেগের আতিশয্যে বলেই ফেললেন, ‘রোজারিওর ছোট্ট ছেলেটা, এই মাত্র স্বর্গে পা রাখল’। শেষ এক বছরে মেসির জীবন বদলে গেছে আরও একবার। ইউরোপ ছেড়ে এখন চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রত্যেকটা সাক্ষাৎকারে একটা কথা অন্তত থাকেই, ‘আমি তো সব পেয়েই গেছি, আমার আবার অতৃপ্তি কীসের?’
ঠিকই তো! স্বর্গারোহনের পর আবার কারো অতৃপ্তি থাকে নাকি?