মাশরাফির আনন্দ-বেদনার বিশ্বকাপ

মাশরাফির আনন্দ-বেদনার বিশ্বকাপ

কষ্টের কাহিনী কষ্টে শেষ!
নিজের বিশ্বকাপ অধ্যায়ের জন্য মাশরাফি বিন মর্তুজা এই শিরোনাম এখন দিতেই পারেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেট মাশরাফির জন্য সত্যিকার অর্থেই আনন্দ-বেদনার কাব্য!
হাসি, চোট, কষ্ট, বাদ পড়ার কান্না, জয়ের আনন্দ, সাফল্য অর্জনের কৃতিত্ব, অধিনায়কত্ব-বন্দনা, টানা নেতৃত্ব এবং শেষ বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা; জীবনীগ্রন্থে বিশ্বকাপ নিয়ে লেখার মতো অনেক অধ্যায় আছে মাশরাফির।

মাশরাফির সেই বিশ্বকাপ অধ্যায় থেকে ঘুরে আসি চলুন।

২০০৩ বিশ্বকাপ
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ দলে যখন জায়গা পান মাশরাফি তখন টগবগে তরুণ। প্রচণ্ড গতিতে বল করতে পারার দক্ষতা ছিল যার। ফাস্ট বোলারদের জন্য নিখুঁত বোলিং রানআপ। সাইড আর্ম অ্যাকশনে পারফেক্ট ল্যান্ডিং! উইকেটের ভেতরে-বাইরে দুই দিকেই বল সুইং করানোর সক্ষমতা ছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে তার বোলিং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র– এই বিবেচনায় তাকে প্রায় অটোমেটিক চয়েজ হিসেবে নির্বাচকরা দলে রাখলেন। শুরুর দুই ম্যাচ খেললেন। দুটি উইকেট পেলেন।
তবে অভিষেক বিশ্বকাপও মাশরাফির শেষ হয়ে গেল মাত্র এ দুই ম্যাচ খেলেই। অনুশীলনে হঠাৎই চোট পেলেন। যাকে বলে ফ্রিক ইনজুরি। আর সেই চোটেই তার প্রথম বিশ্বকাপ শেষ!
বাউন্ডারি দড়ির ওপর পা পড়ল। মচকে যাওয়া গোড়ালি নিয়ে বিশ্বকাপের মাঝপথ থেকেই দেশে ফিরলেন মাশরাফি। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে টিভিপর্দায় দেখলেন বাকি বিশ্বকাপ।
সেখানেও সুখকর কিছু ছিল না! সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোনো ম্যাচই যে জিততে পারেনি! এমনকি কানাডা ও কেনিয়ার কাছেও হারে। কানাকড়ি সব হারানোর সেই বিশ্বকাপ নিয়ে ‘গল্প’ করার কিছুই যে ছিল না বাংলাদেশের। মাশরাফিরও তাই!


২০০৭ বিশ্বকাপ
চার বছর পর আরেকবার বিশ্বকাপ খেলতে নামলেন মাশরাফি। এবং প্রথম ম্যাচেই বুম! ভারতকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ!
কোন ভারতকে?
শচীন, দ্রাবিড়, শেবাগ, সৌরভ, যুবরাজ, ধোনি ও জহির খানের ভারতকে ৫ উইকেটে দাপুটে ভঙ্গিতে হারায় বাংলাদেশ। সেই হারেই মূলত বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল! ভারতকে হারানোর সেই ম্যাচের নায়কও মাশরাফি। ম্যাচে তার পারফরম্যান্স ৯.৩ ওভারে ২টি মেডেনসহ মাত্র ৩৮ রানে ৪ উইকেট। যার মধ্যে ৪২টি ডট বল! ৬টি নো বল ও দুটি ওয়াইড না হলে মাশরাফির এই বোলিং বিশ্লেষণ আরও ক্ষুরধার হতে পারত।
শুরুতে ইনসুইং ডেলিভারিতে শেবাগ বোল্ড! সেই স্পেলেই রবিন উথাপ্পাওকে বিদায় করলেন সিঙ্গেল ডিজিটে। শেষের দিকে অজিত আগারকার ও মুনাফ প্যাটেলকে ফিরিয়ে ভারতের ব্যাটিং লেজও ছেঁটে দিলেন।
ভারত গুটিয়ে গেল মাত্র ১৯১ রানে। জবাবি ইনিংসে তামিম, মুশফিক ও সাকিবের হাফ সেঞ্চুরিতে পোর্ট অব স্পেনে সেই ম্যাচ বাংলাদেশ জিতল ৫ উইকেটে।
ম্যাচসেরা হলেন মাশরাফি। সেই বিশ্বকাপের আরও দুটি ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। খেলে সুপার এইটে। সব মিলিয়েই বিশ্বকাপে মাশরাফির শিকার ৯ উইকেট। বিশ্বকাপ নিয়ে গল্প করার অনেক কিছুই জমা করলেন সেবার মাশরাফি।

২০১১ বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বিশ্ব দেখল মাশরাফির চোখের জল। পায়ের যে ইনজুরি ছিল সেটাকেও হারিয়ে দিয়েছিলেন মাশরাফি। নিজেকে ফিট প্রমাণ করতে লিগের ম্যাচেও খেলছিলেন। কিন্তু কোচ এবং নির্বাচকরা অন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। ইনজুরি সংশয় আছে এটা ধরে নিয়েই মাশরাফিকে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ থেকে বাদ দিলেন নির্বাচকরা। সেদিন বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়ে অন্য ক্রিকেটাররা আনন্দে ভাসেন আর ক্রিকেট একাডেমির মাঠে দাঁড়িয়ে মাশরাফি কাঁদলেন। চোখ গড়িয়ে পড়া এই জলের নাম– কষ্টের কান্না! নিজ মাটিতে বিশ্বকাপ হচ্ছে, আর তাতেই খেলতে না পারার কষ্টের প্রতীক হয়ে আছে মাশরাফির চোখের জল মোছার সেই ছবিটা!
২০১১’র সেই বিশ্বকাপ মাশরাফির কষ্টের, কান্নার ও হতাশার।

২০১৫ বিশ্বকাপ
জীবনকে তিনিই জেতেন, যিনি কষ্টের কান্না হাতের তালুর পিঠে মুছে বলেন– আমি লড়ব। আমি জিতব! ২০১১ সালের কান্নার দিনে মাশরাফি সেই শপথ নিয়েছিলেন বলেই চার বছর পর বাংলাদেশ যখন আবার বিশ্বকাপ খেলতে গেল, মাশরাফি তখন সেই দলের অধিনায়ক! একেই বলে ফিরে আসা! একেই বলে জীবন-জেতা!
মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে পারফরম্যান্স দেখায়, তাতেই আরেকবার চমকে উঠল ক্রিকেটবিশ্ব। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলল সেবার। ক্যানবেরায় প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে সহজেই হারায়। স্কটল্যান্ডের বড় রানের বাধা টপকে যায়। আর অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডকে প্রায় বলে-কয়েই হারিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেয়।
পুরো টুর্নামেন্টে মাশরাফি পান ৭ উইকেট। এর মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার ৯ ওভারে ২০ রানে ৩ উইকেট শিকারের বোলিং স্পেলটা ছিল সবচেয়ে দুর্ধর্ষ। ২০১৫ বিশ্বকাপ নিয়ে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার অধ্যায়টা শুধুই সাফল্যের!

২০১৯ বিশ্বকাপ
মাশরাফি রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর থেকেই একটা প্রশ্ন তাকে হরদম শুনতে হয়েছে– তাহলে ক্রিকেট ছাড়ছেন কবে? পরিষ্কার কোনো উত্তর দেননি মাশরাফি। শুধু আলতো হেসেছিলেন। তবে ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় না নিলেও সেটাই ছিল মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপ। চার বছর আগের সেই বিশ্বকাপও মাশরাফির জন্য ‘সুখকর’ কিছু ছিল না। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছিল ভীষণ ম্লান। ৮ ম্যাচে তার শিকার মাত্র ১ উইকেট! বিশ্বকাপের মাঝপথেই সমালোচনা ওঠে– এমন একজন ননপারফর্মার অধিনায়ক একাদশে রয়েছেন শুধুমাত্র অধিনায়ক কোটায়! সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তিনটি ম্যাচ জেতে। হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
কিন্তু ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স না থাকায় মাশরাফি তুমুল সমালোচনায় পড়েন। এমনকি বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাদশে তাকে না রাখার দাবিও ওঠে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই ম্যাচেও মাশরাফি টস করতে নামেন। বাংলাদেশ সেই ম্যাচও বড় ব্যবধানে হারে। এবং মাশরাফি সেই ম্যাচেও উইকেটশূন্য রইলেন।
ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপে চোট এবং শেষ বিশ্বকাপে হতাশাজনক পারফরম্যান্স। এক বিশ্বকাপে তো দলে জায়গাই হলো না! মাঝের দুই বিশ্বকাপে আনন্দে ভাসলেন।
মাশরাফির বিশ্বকাপ গল্পটা সত্যিকার অর্থেই আনন্দ-বেদনার কাব্য!

সম্পর্কিত খবর