এমন হতে থাকলে স্টেডিয়াম থাকবে, হকি থাকবে না

এমন হতে থাকলে স্টেডিয়াম থাকবে, হকি থাকবে না

আশির দশকে হকির জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে সেসময় আবাহনী ক্রীড়া চক্রের অধিনায়ক ছিলেন মিজানুর রহমান মিজান। এখন তিনি প্রবাসী। বসবাস ইংল্যান্ডে। কিন্তু হকির জন্য এখনো দারুণ উদারপ্রাণ মিজান। প্রতিনিয়ত দেশের হকির খোঁজখবর রাখেন। গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) ঢাকায় মোহামেডান ও আবাহনীর ম্যাচের দিকেও চোখ ছিল তার। কিন্তু এদিন মাঠে হকির বদলে যা ঘটলো তাতে আরো অনেকের মতো মিজানও হতাশ। তবে এই হতাশা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসতে হবে সেই প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন তিনি এই লেখায়।

মাঠে সেদিন কি ঘটেছে সেটা আমরা সবাই দেখেছি এবং জানি। আমি তাই আর সেই বর্ণনায় বিস্তারিত গেলাম না। তবে মাঠে খেলার নামে সেদিন যা হয়েছে তা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য কিছু নয়। এসব ঘটনা খেলাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। বরং খেলা এবং খেলার স্পিরিটকে নষ্ট করবে।

এখন প্রশ্ন হলো খেলার মাঠে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা কেন ঘটলো। কারা এর জন্য দায়ি? দায়ী কি দল, খেলোয়াড়, আম্পায়ার নাকি খোদ ফেডারেশন?

মাঠে খেলোয়াড়রা খেলেন। তারাই মুলত খেলার প্রধান স্টেইকহোল্ডার। কিন্তু মনে রাখতে হবে মাঠের বাইরে থাকা ক্লাব কর্মকর্তা যারা, তাদেরও অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি হকি ফেডারেশন এবং লিগ কমিটি তাদেরও সুষ্ঠ সুন্দর ও স্পোর্টিং পরিবেশে যাতে খেলাটা সুসম্পন্ন হয়- সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। দায়িত্বটা আসলে সবার। এমনকি গ্যালারিতে বসে দলকে যে সমর্থন করছে সেই দর্শকেরও দায়িত্বের ভুমিকা কোনো অংশে কম নয়। বস্তনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আম্পায়ারিং করানোর বিষয়টাও একটা খেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা দেখেছি যে কিছু কিছু সময় আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। তাদের ভুলে জন্য বিভিন্ন ক্লাবকেও ভুগতে হয়েছে। তবে মোহামেডান ম্যাচে এগিয়ে থেকেও কেন মাঠ ছেড়ে, ম্যাচ ছেড়ে চলে গেল এই বুঝটাই আমরা মাথায় আসছে না।

এই সিদ্ধান্ত তো স্রেফ আত্মহত্যা করার মতো! কোন বুদ্ধিতে মোহামেডানের কর্মকর্তার এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? আর মাঠের খেলোয়াড় এবং অধিনায়কই বা কেন সেই হঠকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন?

খেলার নিয়ম অনুযায়ী আম্পায়ার আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা করেছেন। কোন দল খেলা ছেড়ে চলে গেলে বা বাকি সময় খেলতে অস্বীকৃতি জানালে যা হওয়ার কথা, তাই হয়েছে। বাইলজ অনুযায়ী আম্পায়ার আগের স্কোরলাইন বাদ দিয়ে আবাহনীকে ৫-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করেন। মোহামেডানের গোলগুলো স্ক্র্যাপ অর্থাৎ বাদ হয়ে গেছে। আর আবাহনীর আগের গোলের সঙ্গে আরো তিন গোল যোগ করা হয়েছে।

আমি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে হকি খেলেছি। এমনভাবে ম্যাচ জয়ের আসলে কোনো আনন্দ নেই। এই জয়ের ফলে আবাহনী এবং মেরিনার্সের পয়েন্ট এখন সমান। শিরোপা নির্ধারনের জন্য আবাহনী-মেরিনার্সের এখন রিপ্লে ম্যাচের প্রয়োজন হবে। সেই ম্যাচে যারা জিততে তারাই হবে লিগ চ্যাম্পিয়ন। আর যদি রিপ্লে ম্যাচ না হয়, তাহলে উভয় দল যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন।

আবাহনী- মোহামেডানের ম্যাচটা যেভাবে এবং যে কায়দায় শেষ হলো সেটা আসলে হকির জন্য কলঙ্কজনক একটা অধ্যায়। এমনিতেই দেশের হকির দুরাবস্থা এখন। বলা যায় হকি মৃতপ্রায়। সেই পরিস্থিতিতে মাঠে দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের ম্যাচ যে বিশৃঙ্খলায় শেষ হয়েছে সেটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমি ভীষণ হতাশ হয়েছি। সার্বিক অর্থে এই ঘটনায় দেশের হকির আরেকটি বড় ক্ষতি হয়ে গেল। এমনিতেই মাঠে দর্শক আসে না। হকি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শক, স্পন্সর সবাই। এখন তো পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে। হকিকে এগিয়ে নিতে হলে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। ক্লাব, ফেডারেশন, কর্মকর্তা, খেলোয়াড় সবাইকে একজোট হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মাঠে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করার সাহস যেন কেউ না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর যদি বর্তমান অবস্থার মতো মাঠে এমন অরাজকর পরিস্থিতি চলতেই থাকে তাহলে হয়তো হকি স্টেডিয়াম থাকবে, হকি থাকবে না!

# মিজানুর রহমান মিজান, আবাহনী হকি দলের সাবেক অধিনায়ক

সম্পর্কিত খবর