দাবার শেষ চালটা দিয়ে ফেললেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…
তাই বলে সত্যিই এমনি ভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে দাবার বোর্ড থেকে চিরবিদায় নেবেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। যেই বোর্ডে তার এত-এত অর্জন; পরিচিতি পাওয়া, জীবনের লম্বা সময় কাটানো। মায়ায় জড়ানো সেই বোর্ডেই কিনা জীবনের শেষ চালটা দিয়ে ফেললেন জিয়া।
অথচ, আরও একটা অর্জন নিজের করতে কতশত আয়োজন ছিল তার। স্ত্রীকে নিয়ে দাবার মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন জিয়া। দাবা ফেডারেশনের জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতার ১২ তম রাউন্ডে আয়েশি ভঙ্গিমায় লড়ছিলেন আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে। সেই লড়াইয়ের শেষটা দেখা হলো না তার। তার আগেই ডেকে উঠল নাম না জানা পাখি। ফুরলো জীবন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘটনাস্থলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন জিয়া। হাসপাতালে চিকিৎসকদের শত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে জিয়া পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
বেঁচে থাকা অবস্থায় দাবা নিয়ে যখনই কথা বলেছেন জিয়া। তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘এটাই আমার পরিবার। দাবা ফেডারেশন আমার আরেকটা ঘর।’ এই ঘরে এক জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন জিয়া। বহু ছোট ভাই বোনদের বেড়ে উঠতে দেখেছেন। হাত ধরে তাদের শিখেয়েছেন দাবার কঠিন চাল। বাতলে দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে আটকে দেওয়ার গোপন কৌশল। তবে নিজে সেই কৌশল রপ্ত করতে পেরেছেন কি? যেই কৌশলে জীবনটা লম্বা করা যায়, থামতে হয় না ফিফটিতে। হাঁকানো যায় সেঞ্চুরি।
না, সেই কৌশল রপ্ত করতে পারেননি জিয়া। এই কৌশল তিনি কেন কেউই রপ্ত করতে পারেন না কখনোই। তাই এমনি করেই একদিন চলে যেতে হয় সবাইকে। তবে যতক্ষণ বেঁচে থাকা যায় প্রাণভরে বাঁচতে হয়। যা কিছু প্রিয় তাদের কাছাকাছি থাকতে হয়। সেই কাজটা অবশ্য শেষ বেলায় এসেও করেছেন জিয়া। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় যেই জিনিষগুলো তার সবই জিয়া পেয়েছেন শেষ বেলায়।
আজীবন যেই দাবার বোর্ডে সময় কাটিয়েছেন, পরিবারকে সময় দিতে দিতেও যে দাবার এক চাল দিয়ে অন্য কাজ সেরে এসে আরেক চাল দিয়েছেন। সেই তিনি জীবনের শেষ সময়েও পেয়েছেন প্রিয় দাবার বোর্ডকে। তার নিজের দ্বিতীয় ঘর দাবা ফেডারেশনে। সেই বোর্ডে শেষ চালটি দিয়েই বিদায় বলেছেন তিনি।
এদিন বেলা ৩টায় শুরু হওয়া ম্যাচটি। যেখানে লড়ছিলেন দুই গ্র্যান্ডমাস্টার, যেই ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনাও ছিল বেশ। তবে সেই উত্তেজনা নিতে না পেরে ম্যাচের এক পর্যায়ে বেলা ৫টা ৫২ মিনিটে লুটিয়ে পড়েন জিয়াউর। পরে ৯ মিনিটের ব্যবধানে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি তাকে। চিকিৎসকদের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন শেষ পর্যন্ত। হাসপাতালে এসে তাঁর স্ত্রী তাসমিন সুলতানা লাবণ্য কান্নায় ভেঙে পড়েন। জীবনের শেষ দিনেও জিয়ার পাশে ছিলেন লাবণ্য। স্বামীর সঙ্গে যিনি আপন করে নিয়েছিলেন দাবার বোর্ড ও ফেডারেশনকেও। যেই টানে স্বামীর সঙ্গে নিয়মিতই ফেডারেশনে আসতেন লাবণ্য। তবে শেষ বেলায় তাকে একা রেখেই বিদায় নিলেন জিয়া। তার এমন মৃত্যুতে দাবায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এমন একজনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গণেও চলছে শোকের মাতম।
১৯৭৪ সালে জন্ম নেওয়া এই দাবাড়ু বাংলাদেশের হয়ে ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব জেতেন। ২০০৫ সালে বাংলাদেশি দাবাড়ুদের মধ্যে সর্বোচ্চ ফিদে রেটিং ছিল তার। সেবার ২৫৭০ পয়েন্ট অর্জন করেছিলেন তিনি। সেই তিনি অবশেষে ৫০ বছর বয়সে দাবা খেলতে খেলতেই প্রাণ হারালেন। দাবার বোর্ডে গভীর মনোযোগ দিয়ে এখন আর আরেকটি চালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না তাকে। অপেক্ষা করতে হবে না প্রতিপক্ষ কোন চাল দেয় সেটি দেখার। জীবনের শেষ চালটিই যে দিয়ে ফেলেছেন জিয়া।