কিংবদন্তি অ্যাথলেট: অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন কার্ল লুইস

কিংবদন্তি অ্যাথলেট: অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন কার্ল লুইস

অলিম্পিকে ৯টি স্বর্ণপদক জিতেছেন কার্ল লুইস। কিন্তু তার কাছে আছে এখন ৮টি স্বর্ণপদক। নিজের একটি অলিম্পিকের স্বর্ণপদক বাবার কাছে রেখেছেন লুইস।

-বাবার কাছে? কোথায়, আলমারিতে? নাহ, কফিনে!

লুইসের বাবা বিল নিজেও অ্যাথলেট ছিলেন। আমেরিকার ঘরোয়া অ্যাথলেটিক্সে কিছু পদক জিতেছিলেন বিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ মেলেনি তার। ছেলে কার্ল লুইসকে দিয়ে নিজের সেই স্বপ্ন পূরণ হয় তার।

কার্ল লুইস প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। আগে বাবার গুরুদক্ষিণা শোধের সেই আবেগময় ইতিহাসটা জানি। লুইসের বাবা বিল পুরোদস্তুর অ্যাথলেট ছিলেন। শুধু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডেই নয়; ফুটবলেও ভালো দক্ষতা ছিল বিলের। বাবাকে অনুসরণ করতে গিয়েই হয়তো ছেলেবেলায় ফুটবলের সঙ্গে কার্ল লুইসেরও ভালোবাসার শুরু। অবশ্য শেষমেশ ফুটবলার নয়, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই নিজেকে চেনান কার্ল লুইস। বাবা-মা দুজনই ছিলেন অ্যাথলেট গড়ার কারিগর। নিউজার্সিতে অ্যাথলেটিক্স ক্লাবের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করতেন লুইসের বাবা বিল ও মা এভলিন। এভলিন নিজেও ছিলেন হার্ডল রেসে দক্ষ অ্যাথলেট। এমন অ্যাথলেট বাবা- মায়ের ছেলে জগৎসেরা অ্যাথলেট হবে না তো কে হবে? চারটি অলিম্পিক থেকে সব মিলিয়ে ৯টি স্বর্ণপদক গলায় পরেন কার্ল লুইস। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি ১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকের ১০০ মিটার দৌড়ের সেই স্বর্ণপদকটা বাবার হাতে তুলে দেন। লুইসের জেতা সেই স্বর্ণপদকটাই এখন সবচেয়ে যত্নে রয়েছে, বিলের সঙ্গে তার কফিনে!

১৯৮৮ সালের মে মাসে কার্ল লুইসের বাবা বিল মারা যান। শিক্ষক বাবার প্রতি পরম ভক্তির শ্রদ্ধা হিসেবে কার্ল লুইস ১৯৮৪ সালের অলিম্পিকের ১০০ মিটার দৌড়ে জয়ী সেই স্বর্ণপদক বাবার কফিনে রেখে আসেন। সেই প্রসঙ্গে লুইসের স্মৃতিচারণ-'বাবা সবসময় চাইতেন আমি যেন ১০০ মিটারের মেডেলটা জিতি। এখন সেই মেডেল তার কাছে এবং আমিও সবসময় থাকছি তার সঙ্গেই!' পিতৃভক্তিতেও সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন কার্ল লুইস! ১৯৬১ সালের ১ জুলাই

অ্যালাবামার বার্মিংহামে জন্ম নেওয়া কার্ল লুইস তো হাঁটতেই শিখেছেন অ্যাথলেটিক্সের কমলা রংয়ের ট্র্যাকে! ১৯৫১ সালে লুইসের বাবা-মা দুজনই প্যান-আমেরিকান গেমসে অংশ নেন। পরে অ্যাথলেট কোচ হিসেবে শিক্ষকের চাকরি করেন। কার্ল লুইসের চার ভাই-বোনের সবাই অ্যাথলেট। সারা দিন দৌড়ঝাঁপ নিয়ে সময় কাটে। তবে ভাই-বোনদের মতো শৈশবে অ্যাথলেটিক্সে তেমন দক্ষ ছিলেন না লুইস। বরং ফুটবলই একটু বেশি ভালো খেলতেন। হালকা-পাতলা গড়নের শরীরে পেশি তেমন ছিল না। উচ্চতায় ছোটখাটো। সমবয়সীদের সঙ্গে অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে নামলেও প্রতিবারই ফিনিশিং লাইনে পৌঁছতেন সবার শেষে!

-নাহ, একে দিয়ে অ্যাথলেটিক্সে হবে না, এমন সিদ্ধান্ত একসময় প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন তার বাবা-মা। অ্যাথলেটিক্স বাদ দিয়ে তাকে মিউজিক ক্লাসে ভর্তি করানোর চিন্তাও করছিলেন তারা।

শেষমেশ সেদিনের সেই 'ব্যর্থ' ছেলেটাই একদিন অ্যাথলেট বিশ্বকে চমকে দেয়। আমেরিকার ইতিহাসে, শুধু আমেরিকা বলছি কেন- গোটা বিশ্বের ইতিহাসে সেরা অ্যাথলেটের নাম লিখতে হলে সেই তালিকার শীর্ষে রাখতে হবে ফ্রেডরিক কার্লটন লুইসকে। বিশ্ব যাকে চেনে মূলত কার্ল লুইস নামে।

-ছেলেবেলার সেই ব্যর্থ অ্যাথলেট কীভাবে জগৎসেরা এক চ্যাম্পিয়ন হল?

এ প্রশ্নের উত্তরকে সংক্ষিপ্ত মনে হতে পারে। কিন্তু সেই অর্জনকে নিজের মতো করে পেতে যে আত্মত্যাগ ও কঠিন পথচলা পার করতে হয়- কার্ল লুইস হচ্ছে তার দারুণ এক উদাহরণ। অলিম্পিকে তার অভিষেক হতে পারত সেই ১৯৮০ সালে। কিন্তু অলিম্পিকের মাঠে নামার আগেই কার্ল লুইস দেখেন স্পোর্টস দুনিয়ায় রাজনীতির নোংরামো! মস্কোর সেই অলিম্পিক আমেরিকা বয়কট করে। অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য মার্কিন ক্রীড়াবিদরা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রস্তুত ছিলেন কার্ল লুইসও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মার্কিন সরকার গেমস শুরুর কিছুদিন আগে হঠাৎ করে ঘোষণা দেয়-রাশিয়ান সরকার আফগানিস্তানে সামরিক হামলা চালিয়েছে, সে কারণে তারা মস্কো অলিম্পিক বয়কট করছে। আমেরিকার সেই বয়কটের কারণেই কার্ল লুইসের অলিম্পিক অভিষেক চার বছর পিছিয়ে গেল। ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে পাল্টা বয়কট হিসেবে আবার রাশিয়া এল না! তবে এবার কার্ল লুইসের তারকা হয়ে ওঠা কেউ ঠেকাতে পারল না। অলিম্পিকে নিজের অভিষেকেই ৪টি স্বর্ণপদক জেতেন কার্ল লুইস। সেই সঙ্গে স্বদেশি জেসি ওয়েন্সের এক অলিম্পিকে ৪টি স্বর্ণপদক জয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেন। জেসি ওয়েন্সের পর আফ্রো-আমেরিকান অ্যাথলেট হিসেবে কার্ল লুইস দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এ রেকর্ডের মালিক হন। ১৯৮৪ সালে শুরু। থামলেন ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে। টানা ৪টি অলিম্পিকে কার্ল লুইস জিতেছেন ৯টি স্বর্ণপদক। ৪টি ইভেন্টে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে একসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার রিলে দৌড় এবং লং জাম্প-এ চ্যাম্পিয়ন কার্ল লুইস।

অথচ ছেলেবেলায় যিনি প্রতিটি দৌড়ে সবার শেষে থাকতেন! রহস্যটা জানতে চান? কার্ল লুইস আগের উত্তরটাই দিচ্ছেন-দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম, প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলা।

এক নজরে কার্ল লুইসের অলিম্পিকের ৯টি স্বর্ণপদক

১৯৮৪ অলিম্পিক  (১০০ মিটার , ৯ দশমিক ৯ সেকেন্ডে)

১৯৮৪ অলিম্পিক  (২০০ মিটার, ১৯ দশমিক ৮ সেকেন্ড)

১৯৮৪ অলিম্পিক  (৪x১০০ মিটার রিলে রেস)

১৯৮৪ অলিম্পিক  (লং জাম্প (২৮.২ ফুট)

১৯৮৮ অলিম্পিক  (১০০ মিটার)

১৯৮৮ অলিম্পিক  (লং জাম্প)

১৯৯২ অলিম্পিক  (৪x১০০ মিটার রিলে রেস)

১৯৯২ অলিম্পিক  (লং জাম্প)

১৯৯৬ অলিম্পিক  (লং জাম্প)

সম্পর্কিত খবর