কায়জারের শেষ বাঁশি!
১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। মিউনিখ শহরতলীর একটি ঘরে আনন্দের বন্যা। স্টিফেন বেকেনবাওয়ার বাবা হয়েছেন। স্ত্রী অ্যান্টোনিও’র কোল জুড়ে এসেছে পুত্রসন্তান। ডাক বিভাগের কর্মী স্টিফেন তার ছেলের নাম রাখেন-ফ্রাঞ্জ। পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রিয়ার সাবেক সম্রাটের নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখেন স্টিফেন। বুক ভরা স্বপ্ন ছিল ছেলেও একদিন সম্রাটের মতোই রাজ্যজয়ী হয়ে উঠবে।
ফ্রাঞ্জ নামের সেই ছেলেটা সত্যিকার অর্থেই তার নামের মর্যাদা রাখল। হয়তো দেশ-সাম্রাজ্য জয় করতে পারেনি। কিন্তু সে ফুটবল খেলে জিতেছিল গোটা বিশ্বের মানুষের ভালোবাসা, হৃদয়। মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই জার্মানির বিখ্যাত ক্লাব বার্য়ান মিউনিখে তার পথচলা শুরু। সেই ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার একসময় হয়ে উঠলেন জার্মানির ফুটবলের সত্যিকারের সম্রাট। লোকে তার খেলা এবং তাকে এতো বেশি ভালোবাসতো যে ডাকা শুরু করলো-হের কায়জার! যার আভিধানিক অর্থ জার্মানির সম্রাট!
ফ্রাঞ্জ অ্যান্টন বেকেনবাওয়ার যেখানেই হাত দিয়েছেন, আক্ষরিক অর্থেই সোনা ফলেছে। খেলোয়াড় হিসেবে, কোচ হিসেবে, ফুটবল সংগঠক হিসেবে; ত্রয়ী ভূমিকায় সাফল্য লুটিয়েছে তার পায়ে এসে। খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তালিকা তৈরি করলে সেই একাদশে বেকেনবাওয়ারকে আপনার রাখতেই হবে। তার সাফল্যের রেকর্ডই তাকে এই মর্যাদা দিচ্ছে। খেলোয়াড় হিসেবে ক্লাবের হয়ে ভুরি ভুরি শিরোপা জিতেছেন। জাতীয় দলের হয়েও জিতেছেন মর্যাদাসম্পন্ন প্রায় সব আন্তর্জাতিক ট্রফি। এই তালিকায় সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি অর্জন হল দুবার বিশ্বকাপ জয়। একবার খেলোয়াড় হিসেবে। আরেকবার দলের কোচ হয়ে।
তাকে বলা হয় আধুনিক ফুটবলের অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা পজিশনের স্রষ্টা। আজকের দিনে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের আক্রমণভাগে উঠা আসাটা নিয়মিত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পজিশনকে লিবারো নামে ডাকা হয়। ফুটবল মাঠের কৌশলে এই পজিশনের স্রষ্টা হিসেবে অনেকেই বেকেনবাওয়ারকে পূর্ণ কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন। রক্ষণে প্রাচীর হয়ে থাকার পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে হয়ে উঠতেন প্রকৃত আক্রমণভাগের খেলোয়াড়।
ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল তার মিডফিল্ডার হিসেবে। পরে খেলেন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার পজিশনে। তবে শুধু গোল বাঁচানো এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করার কাজেই সব সময় নষ্ট করেননি বেকেনবাওয়ার। বল নিয়ে ডিফেন্স থেকেই হয়ে উঠেন দারুণ বল প্লেয়ার। উঠে আসতেন আক্রমণভাগে। প্রতিপক্ষের সীমানায় ত্রাস হয়ে। আর তাই নামের পাশে ডিফেন্ডার লেখা থাকলেও ক্লাব ফুটবলে বেকেনবাওয়ারের গোলসংখ্যা বিস্ময়কর! ৫৮৭ টি ক্লাব ম্যাচে তার গোলের সংখ্যা ৮১। আর জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১০৩ ম্যাচ। গোল করেছেন ১৪টি। অনেক ম্যাচে তার গোলই জয়ের সূচক হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বকাপে তার সাফল্য দুর্দান্ত। কোচ ও খেলোয়াড় হিসেবে মোট পাঁচটি বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তার। এই পাঁচবারের মধ্যে চারবারই তার দল ফাইনালে খেলেছে। খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে তার অভিষেক হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। সেবার ওয়েম্বলির ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে রানার্স আপ হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি।
১৯৭০ সালে দুর্দান্ত ফুটবল খেলে বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানি। আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে আসে। কিন্তু সেমিফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ৩-৪ গোলে হার মানে জার্মানি। ‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে পরিচিত সেই ম্যাচে কাঁধে চোট পান বেকেনবাওয়ার। কিন্তু মাঠ ছাড়েননি। গলায় হাত ঝুলিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে মাঠে লড়ে যান। দেশের জন্য কিভাবে নিজেকে নিংড়ে দিতে হয়, তার দারুণ একটা উদাহরণ তৈরি করেন সেদিন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। সেই বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়েছিল পশ্চিম জার্মানি।
১৯৭৪ বিশ্বকাপে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানিকে কেউ রুখতে পারেনি। ক্রুয়েফের নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানি ২-১ গোলে ফাইনাল জিতে। অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
আর কোচ হিসেবে এই কৃতিত্ব দেখান ১৯৯০ সালে। ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জার্মানি। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল জার্মানি। সেই বিশ্বকাপে আয়োজক কমিটির প্রধান ছিলেন বেকেনবাওয়ার। ইটস টাইম টু মেক ফ্রেন্ড-এই শ্লোগানে সেই বিশ্বকাপে আয়োজক হিসেবে জার্মানি সত্যিকার অর্থেই বাকি বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে।
খেলোয়াড়-কোচ এবং সংগঠক সব ভূমিকায় সত্যিকার অর্থেই সম্রাটের মতোই রাজ করে গেলেন কায়জার। ২০২৪ এর ৮ জানুয়ারি জীবন ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজিয়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। যে জগতে পেলে, ম্যারাডোনা, সক্রেটিস, মারিও জাগালোর সঙ্গে নতুন যোগ হওয়ায় কায়জার ফুটবল আড্ডা জমিয়ে তুলবেন!