এই দল (বাংলাদেশ) শুধু খেলতে আসে, জিততে না!
কী করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ এই ম্যাচে?
ম্যাচের অর্ধেক পথেই জানা ছিল আফগানিস্তানের ১১৫ রান ১২.১ ওভারে জিততে না পারলে কোন লাভ নেই। এর চেয়ে বেশি ওভারে ম্যাচ জিতলেও সেমিতে যাওয়া সম্ভবপর হবে না। শুরুতে বাংলাদেশের রান তাড়া দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিই তারা ১২.১ ওভারেই ম্যাচটা জিততে চায়। কিন্তু ক’টা উইকেট হারানোর পর পুরো দলের ব্যাটিং পরিকল্পনাই বদলে গেল? গুটিয়ে গেলেন ব্যাটাররা। কোনো মতে ম্যাচ যেন জেতা যায়-সেটাই টার্গেট হয়ে গেল!
দলের এই ব্যাটিং পরিকল্পনা যে মোটেও সঠিক কিছু ছিল না, তা নিয়ে মাশরাফিও ক্ষোভ জানিয়ে লিখলেন, ‘এভাবে ম্যাচ জিতলে বিবেকের কাছে হেরে যেতাম।’
যে জয় আপনাকে সামনে এগিয়ে নেবে না, কেবল একটা সংখ্যা হয়ে থাকবে সেই জয়ে তৃপ্তি ও সুখ খোঁজার অর্থই হলো আপনার স্বপ্ন ও উন্নতি করার সীমা কোমরে গোঁজা খুচরোর সমান! ঝনঝন করবে কিন্তু ওদিয়ে আজকাল বিড়িও কিনতে পারবেন না!
বিশ্বকাপের সুপার এইটের তিন ম্যাচে কি পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ? কেন তাদের চেষ্টা ও তাগিদে ঘাটতি ছিল? অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ কি তারা জিততে নেমেছিল, নাকি কেবল অংশগ্রহণ করতেই মাঠে এসেছিল? আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে কেন ১২.১ ওভারে জেতার চেষ্টাটা জোরদার হলো না। ২০ ওভারে ম্যাচ জিততে চেয়ে কি অর্জন করতে চেয়েছিল দল? সেই প্রশ্ন তুলে পুরো কোচিং স্টাফ এবং টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে এখন বিসিবির জবাবদিহি চাওয়ার সময়।
উত্তর সন্তোষজনক না হলে তাদের সবাইকে ছাঁটাইয়ের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া উচিত। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের ম্যাচে বাংলাদেশ পুরোটা সময় জুড়ে যে ব্যাটিং করেছে তাতে কখনোই মনে হয়নি আমরা ম্যাচটা জেতার চেষ্টা নিয়ে ব্যাট করছি। মনে হয়েছে এই ম্যাচে বাংলাদেশ কেবল অংশগ্রহণকারী দল। কোনো মতে ২০ ওভার খেলে পার করে দিলেই হলো! দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানই তো বিশ্বকাপ চলাকালেই এই অভিযোগ তুলেছেন- ‘ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচের কথাই বলি, আমরা আসলে এই ম্যাচ জেতার জন্য যেমন ব্যাটিং করার কথা ছিল, সেটা করতেই পারিনি। সেই তাগিদ বা চেষ্টা দেখাতে পারিনি। আমরা যে রান তাড়া করে ম্যাচ জেতার মতো একটা চেষ্টা করছি, সেটাই তো মানুষকে দেখাতে পারলাম না!’
একই রকম অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর গলায়ও- ‘আমার কাছে মনে হয়েছে দলের সবার বড় ইনিংস খেলার সামর্থ্য আছে। কিন্তু বিশ্বকাপে কেন হচ্ছে না, এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও নেই।’
অর্থাৎ খোদ অধিনায়কই দলের সামর্থ্যের খোঁজে অন্ধকারে! তাহলে এই দল আলোর সন্ধান পাবে কিভাবে?
একাদশে অদল বদল হতেই পারে। কিন্তু সেখানেও ক্রিকেটীয় যুক্তি থাকবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই যুক্তির জায়গায় যদি স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসে তখন জবাবদিহিতা অবশ্যই খুঁজতে হবে। কোনো যুক্তি ছাড়াই তাসকিন আহমেদকে ভারত ম্যাচে বাদ দেওয়া হলো। ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে আগে বোলিংয়ের মতো ভীতু সিদ্ধান্ত কোন যুক্তিতে? পুরো বিশ্বকাপে দলের সেরা ব্যাটসম্যান তাওহীদ হৃদয়, একমাত্রই তাকেই দলের টি-টোয়েন্টি ধাঁচের ব্যাটসম্যান মনে হচ্ছিল, সেই তাকে আফগান ম্যাচে খেলানো হলো ছয় নম্বরে!
ডান হাতি বাম হাতির এই ফালতু ম্যাচআপ থেকে কবে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ? ডানহাতি বোলার ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পারবেন না বা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান থাকলে বাঁহাতি বোলার বোলিংয়ে আসবেন না-এসব বিশ্লেষণ তো স্রেফ ভেল্কিবাজি। রশিদ খান তার ক্যারিয়ারে ডান হাতি বাঁহাতি এমনকি দুহাতেই ব্যাট করা ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন। সাকিবও তাই। দলের সেরা বোলারকে আপনি এক ওভারও বোলিং-ই দিবেন না! আবার সেরা ব্যাটারকে কেন ছয় নম্বরে খেলাবেন? তিনি যেহেতু সেরা, তার সেরাটা নিতে হলেও তাকে বেশি বল খেলার সুযোগ দিতে হবে- সহজ হিসেব।
সুপার এইটে খেলার আগে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে গলায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন, এখন আমরা এই পর্ব থেকে যা পাবো সেটা বোনাস। তার এই কথার অর্থ কি? তার মানে কি গ্রুপ পর্বেই সব অর্জন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ? এখন আমরা হয়তো বলতে শুনবো, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটাই বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। আগে কোনোবারই আমরা তিনটা ম্যাচ জিততে পারিনি। এবার জিতেছি। তাও আবার লাগাতার জয়।
সম্ভবত এই সাফল্যে বুঁদ হয়েই কোচ সুপার এইটে ‘বিশ্বকাপ বোনাস’ এর স্বপ্ন দেখছিলেন।
ধাঁতে, চিন্তায়, কৌশলে, জেদ-জোস, স্কিলে এবং সর্বোপরি সামর্থ্যে যতদিন না পর্যন্ত আমরা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারবো ততদিন আমাদের শুধু সেই খোঁটা শুনতে হবে- ‘এই দল শুধু খেলতে এসেছে, জিততে নয়!’
টি- টোয়েন্টিতে দলের প্রয়োজনে নিজের খেলার ধরন বদলাতে হয় দ্রুতই। ঝুঁকি নিতে হয়। নতুন শটস তৈরি করতে হয়। সেই নজিরের কোনো কিছুই তো এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দেখাতে পারলো না। দলের কয়েকজন ব্যাটসম্যানের খেলা দেখে মনে হচ্ছে এরা কেবল নিজেকে বাঁচাতে, নিজেকে ফর্মে ফেরাতে ক্রিকেট খেলছেন। দলের জয়ের জন্য নয়। লড়াই করার যে তাগিদ, চেষ্টা এবং ঝাঁপিয়ে যুদ্ধ জয়ের শারীরিক ভাষা-সবকিছুরই যে ঘাটতি এই দলে।
এই নেতিয়ে পড়া মানসিকতা ও মেজাজ নিয়ে খেললে আপনি শুধু খেলতেই নামবেন, জিততে পারবেন না। কারণ আপনার তো চেষ্টাই নেই!
গাড়ীতে বেশি সমস্যা ধরা পড়লে ইঞ্জিন ওভারহোলিং করতে হয়। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দলেও সেটাই প্রয়োজন। ৮০, ৯০ ও ১০০’র বেশি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটাররা যখন আমাদের কিছু দিতে পারছেন না তাহলে তাদের পেছনে আর বিনিয়োগ কেন?
ক্রিকেট বোর্ড কি সেই সাহস দেখাতে পারবে?